একদৃষ্টে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল রাজীব। আরব সাগরের অশান্ত, উত্তাল ঢেউ সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ কেন জানি না রাজীবের উত্তাল অশান্ত হৃদয়ের চেহারাই বারবার প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের অন্তহীন বুক জুড়ে।
সঞ্জনার চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল রাজীবের চোখের সামনে। কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিল না সঞ্জনা ছাড়া। সারা পৃথিবীতে কী ঘটে চলেছে তার সঙ্গে রাজীবের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। ও শুধু নিজের জগতেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল।
সঞ্জনা রাজীবের বিবাহিতা স্ত্রী। মা, বাবার দেখে দেওয়া পাত্রীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। তিন বছরের বিবাহিত জীবন ওদের। সঞ্জনা ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কল্পনাও করতে পারত না রাজীব। এক স্বর্গীয় ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে রাজীব তুলে ধরেছিল সঞ্জনার হাতে।
চাকরি এবং স্ত্রী সঞ্জনাকে নিয়ে রাজীব মুম্বই শহরে এসে পৌঁছেছিল। তিন বছর ওদের কোনও সন্তান হয়নি। এই নিয়ে কোনও দুঃখও ছিল না রাজীবের মনে। সঞ্জনাই ওর পুরোটা জুড়ে ছিল। সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি রাজীব। সঞ্জনা ছাড়া ও কিছুই প্রত্যাশা করত না। তবুও দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আসার সংবাদ ডাক্তারের মুখে শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব। বেশি খুশি হয়েছিল সঞ্জনার জন্য।
কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস স্বীকার করা ছাড়া আর কী-বা করতে পারল রাজীব? সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে রাজীবকে ত্যাগ করে সঞ্জনা কোথায় হারিয়ে গেল। রাজীব, কন্যাসন্তান, গোছানো সংসার সবই পড়ে থাকল শুধু গুছিয়ে রাখার মানুষটাই স্নেহ, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে রাজীবের হৃদয়টাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।
বাড়িতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু সঞ্জনার স্মৃতি। সবথেকে বেশি সঞ্জনার কথা মনে হতো সঞ্জনার ফেলে যাওয়া একরত্তি ওই মেয়েকে দেখলে। রাজীব যেন মনে মনে সঞ্জনার মৃত্যুর জন্য মেয়েকেই দাযী করে বসল। ওর দিকে তাকালেই মনটা আরও বেশি হুহু করে উঠত।
বেঙ্গালুরু থেকে রাজীবের মা-বাবা মুম্বই এসেছিলেন পুত্রবধূ বাড়ি ফিরলে সংসার সামলাতে যাতে কষ্ট না হয় সঞ্জনার ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিন্তু সেই সঞ্জনাই ফিরল না। ঠাকুমা-ঠাকুরদাই নাতনিকে আপন করে নিলেন। স্নেহ মমতা দিয়ে ওইটুকু প্রাণকে আগলে রাখার চেষ্টা করে চললেন। ছেলেকে ওনারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজীবের মন কিছুতেই ভিজল না। জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখল সে।
অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে রাজীবের মা-বাবা একমাত্র নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। রাজীব মুম্বইতে একাই রয়ে গেল। তার জীবনে ভালোবাসা রূপকথা হয়ে রয়ে গেল।
সঞ্জনার মৃত্যুর প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কেটে গেছে এই দীর্ঘ সময়টা। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুরই খেয়াল করেনি রাজীব। তাহলে আজ হঠাৎ আবার সাগরের একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে, কেন তার হৃদয় এতটা উদ্বেলিত হচ্ছে রাজীব বুঝতে পারছে না! সঞ্জনাকে দেখে তো এমনটা হতো কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তো জীবনে একবারই আসে। তাহলে আজ কীসের জন্য মন এতটা অশান্ত? তাহলে কারও প্রতি কি তার মন আকর্ষিত হচ্ছে? না না এ হতে পারে না। সঞ্জনার উপর কোনও অন্যায় অবিচার সে হতে দিতে পারে না। এ অন্যায়।
রাজীব স্বপ্নেও ভাবেনি এই মুহূর্তটুকু আবার তার জীবনে প্রবেশ করবে। মানসিক এই টানাপোড়েন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল রাজীবের ভিতর। প্রতিবেশী মেয়েটির চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একজন প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু সবকিছুকে রাজীব কিছুতেই একটা সরলরেখায় ফেলতে পারছিল না।
ছয় মাসের হয়তো একটু বেশিই হবে সামনের খালি ফ্ল্যাট-টায় ওই মেয়েটি এসেছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললেই হয়তো ঠিক হবে কারণ রাজীবের মনে হয়েছিল মহিলার বয়স তিরিশের আশেপাশে। বারান্দায় দাঁড়ালে রাজীবের ঠিক উলটো দিকে সেই ফ্ল্যাট। দুটো ফ্ল্যাটের মুখোমুখি বারান্দা।
রাজীবের প্রথম চোখে পড়ে যখন মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে। এছাড়া খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে চোখে পড়েছিল লোক দিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র সব গুছিয়ে তুলছিল ওই মহিলা। ব্যস অতটুকুই।
অফিসে যাওয়া-আসার পথে, লিফট-এ প্রায়শই দেখা হতো। অনেকেরই সাথে তো রোজ দেখা হয়, তাহলে বিশেষ করে ওই একজনের প্রতি কেন আকর্ষণ অনুভব করত রাজীব, নিজেই বুঝতে পারত না। হয়তো একাকিত্ব বোধ থেকে অথবা শরীরের অপ্রতিরোধ্য চাহিদা থেকে, এর মধ্যে কোনটা সেটা রাজীবের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না।
একদিন লিফ্ট থেকে বেরোতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে কোনও ভাবে পা মুচকে গিয়ে মহিলা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, রাজীব কোনওরকমে ধরে ফেলে। হাত ধরে বাইরে রাখা একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রাজীব।
দেখি কোথায় লাগল আপনার, বলে নীচু হয়ে রাজীব আঘাতের জায়গাটা দেখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় মহিলা পা-টা সরিয়ে নিল।
না না, আমি ঠিক আছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলতে বলতে মহিলা চেয়ারে বসেই পা-টাকে একটু নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কোনও সাহায্য লাগলে বলুন…
না না ধন্যবাদ। ঠিক সামলে নেব…
কথা না বাড়িয়ে রাজীব অফিসের পথে পা বাড়াল। কিন্তু সারাটা দিন মুহূর্তের ওই স্পর্শটুকু কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না।
দুতিন দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখল মহিলাকে। এর মধ্যে দেখা হলে মৌখিক হাসি বিনিময় হতো আর মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে কথা। মহিলা রাজীবের মনে চেপে বসে থাকা বরফের চাঁইটাকে একটু একটু করে গলাতে শুরু করল।
এর পর হঠাৎ করেই তিন-চারদিন আবার দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল রাজীব। বারান্দার দরজাও রাতদিন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রাজীবের মন কেঁপে উঠল।
মহিলার ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত হবে কিনা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না রাজীব। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল-এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখল ওই মহিলার বাড়ির কাজের মাসি সামনে দাঁড়িয়ে
সাহাব, একবার ওই ফ্ল্যাটে চলো। মেমসাহেবের শরীর খুব খারাপ, কী করব আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলে ওঠে মাসি।
রাজীব তত্ক্ষণাৎ মহিলার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় মাসির সঙ্গে। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মহিলা, দেখে হুঁশ আছে বলে মনে হল না।
কোনও ডাক্তার দেখেছে? চিন্তিত হয়ে মাসিকেই জিজ্ঞেস করে রাজীব।
মাথা নাড়ায় মাসি।
সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে রাজীব। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধপত্র সব লিখে দিয়ে যান। ওষুধগুলো মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নেয় রাজীব। পালা করে মাসির সঙ্গে মাথায় জলপট্টি করতে থাকে যাতে জ্বরের পারদ একটু নামে। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয় মহিলাকে। ধীরে ধীরে জ্বর কিছুটা কম হলে রাজীব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।
পরের দিন মহিলাকে একটু সুস্থ দেখে রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনার আত্মীয় কেউ আছেন যাকে খবর দিতে হবে? আপনি বললে আমি ফোন করে দিতে পারি। হালকা করে মাথা নেড়ে না বলে মহিলা। সুতরাং তার খাওয়াদাওয়া, সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়ানোর দাযিত্ব রাজীব নিজের উপরেই নিয়ে নেয়। রাজীব বুঝতে পারছিল এর ফলে মহিলা সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যার জন্য কিছু বলতে পারছে না।
চারদিন পর রাজীব মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখল, এতদিন পর বিছানায় উঠে বসেছে মহিলা। অনেক সুস্থ লাগছে ওকে। রাজীব ঘরে ঢুকতেই মহিলা বলে উঠল, আপনাকে এতদিন ধরে অনেক কষ্ট দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।
ক্ষমা কীসের জন্য? প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর কাজে আসে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
হ্যাঁ, ভাবছি কালকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরশু থেকে অফিস জয়েন করব। কোনও কিছুর দরকার আছে কিনা জেনে নিয়ে রাজীব অফিস বেরিয়ে পড়ে।
এর পর মেলামেশা আরও একটু গাঢ় হয়। একসঙ্গে ডিনার সারা, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করা ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।
জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল রাজীব। আকাশ এত নীল আগে কখনও খেয়াল করেনি। হয়তো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার কথাই মনে হয়নি। হৃদয়ে যখন শূন্যতা জায়গা জুড়ে বসে তখন সবকিছুই কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাস হল আকাশে রঙের আনাগোনা লক্ষ্য করছে রাজীব।
আজ সন্ধেবেলা দুজনে ডিনারে যাওয়ার কথা আছে। এতদিন ধরে মেলামেশা করছে, রাজীবের মনে হল আজ পর্যন্ত সঙ্গিনীর নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য দুজনের কেউই আজ পর্যন্ত নিজেদের অতীত নিয়ে কখনও কথা তোলেনি।
ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলা শুরু করলে রাজীবই প্রসঙ্গ তুলল, এতদিন হয়ে গেল, আপনার নামটাই এখনও জানা হল না।
অনসূয়া, হাসিতে ভরে গেল মহিলার মুখ।
বাঃ, ভারী সুন্দর আপনার নাম। অত্রি মুনির স্ত্রী ছিলেন সতীসাধ্বী অনসূয়াদেবী। রামায়ণে আমরা তাঁর বর্ণনা পাই, আপনিও নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন?
মায়ের মুখে এই গল্প বহুবার শুনেছি। হেসে উত্তর দেয় অনসূয়া।
কথা বলতে বলতেই খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেয় রাজীব।
আরও কিছু বলুন নিজের সম্পর্কে। আমরা কেউই একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবেই বলুন! সামান্য দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বলে রাজীব।
অনসূয়া চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।
ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না, ব্যস্ত কণ্ঠে রাজীব বলে ওঠে।
না না, সেরকম কিছু নয়। এতদিনে এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়ে গেছে। আমি নিজের কথা আপনাকে খুলে বলতে পারি। চলুন, খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে সব বলব। চোখ নীচে নামিয়ে অনসূয়া কিছুটা সময় চেয়ে নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে।
খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অনসূয়া তারপর ধীর স্বরে বলতে আরম্ভ করল, আমরা দুজনেই এমবিএ করছিলাম। ছেলেটিও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমরা লিভ ইন করতে শুরু করি। আমার মা-বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল এই সম্পর্ক থেকে সরে আসার জন্য। প্রচুর বকাবকিও করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। মা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিন্তু আমিই শুনিনি।
আমার মনে হয়েছিল, যখন দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তখন বিয়ের বন্ধনের দরকারটা কোথায়? এছাড়া তখন বিয়ে করা সম্ভবও ছিল না। মা-বাবা রাগ করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর পর আমরাও চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু আলাদা আলাদা শহরে। চেষ্টা করছিলাম দুজনের চাকরি যাতে এক শহরে হয়।
আমার বয়ফ্রেন্ড কখনও ছুটি পেলে আমার কাছে চলে আসত, কখনও আমি ওর কাছে চলে যেতাম। এই ভাবে প্রায় একটা বছর কেটে যায়। তার পর হঠাৎই খেয়াল করি ও না আসতে পারার জন্য রোজ নতুন নতুন বাহানা দিচ্ছে। একটু জোর দিতেই ও স্বীকার করে নেয়, অন্য একটি মেয়েকে নাকি সে এখন ভালোবাসে। এটা কী করে সম্ভব? আমি তো জানতাম ভালোবাসার আনন্দ একবারই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দ্বিতীয়বার কি আর কখনও সেভাবে ভালোবাসা যায়? আপনিই বলুন…। কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢাকে অনসূয়া।
রাজীব অনসূয়ার হাত ধরে সামনে থাকা একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দেয়।
না না আপনিই বলুন দ্বিতীয়বার কি আর ভালোবাসা আসে জীবনে? অশ্রুসজল নয়নে অনসূয়া প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় রাজীবকে।
উত্তর দেয় না রাজীব। দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে সে। অনসূয়া ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, তার মানে আপনি বলতে চান প্রথমটা ভালোবাসা ছিলই না। শুধুই শরীরী আকর্ষণ মাত্র!
না আমি সেরকম কিছু তো বলিনি, তবে ভালোবাসা…, চুপ করে যায় রাজীব।
হ্যাঁ, ভালোবাসা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। অনসূয়ার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।
আমিও এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, গভীর নিঃশ্বাস নেয় রাজীব। যে ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। আমিও প্রাণের থেকে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মৃত্যু হয়। তখন মনে হয়েছিল এটাই আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা যতদিন না… বলতে বলতে রাজীব চুপ হয়ে যায়।
যতদিন না… একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অনসূয়া রাজীবের দিকে তাকায়। রাজীব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
কী হল, বললেন না? তাহলে কি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন? অনসূয়ার দৃষ্টির গভীরতা রাজীবকে বিদ্ধ করে।
হঠাৎ রাজীব তাড়া দেয় অনসূয়াকে, চলুন রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফেরা যাক।
অনসূয়া রাজীবের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে, আগে কথা শেষ করুন।
অনেক রাত হল, এবার ফেরা যাক।
না, আগে আমাকে বলুন, অধীর হয়ে ওঠে অনসূয়া।
কী বলব। হ্যাঁ ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি অনসূয়া। উত্তেজিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তার।
না, না এ কিছুতেই হতে পারে না! অনসূয়া ছেড়ে দেয় রাজীবের হাত।
অনসূয়া শোনো, তোমার প্রতি আমার এই অনুভতি যে তোমারও থাকবে এই দাবি কখনও-ই করি না। আমার এই অনুভতি যে আমাদের বন্ধুত্বের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।
পরের দিন দুজনের দেখা হলেও কথা বলার খুব একটা সুযোগ হল না। রাজীবও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল।
দ্বিতীয় দিন অনসূয়া জানাল, তাকে পাঁচদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে মায়ের শরীর খারাপের খবর আসাতে রাজীব ছুটি নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এল। মেয়েকে এই প্রথম নিজে থেকে কোলে তুলে নিল রাজীব। আজ এই প্রথমবার তার মনে হল না এই মেয়ের জন্যই সে সঞ্জনাকে হারিয়েছে চিরজীবনের মতো। মনে আজ আর কোনও বিদ্বেষ নেই, রাজীব মনে শান্তি অনুভব করল। সঞ্জনার স্মৃতি আজ দুঃখ দিল না। বরং তার মনে হল, সঞ্জনা জীবনে পুরো ভালোবাসা পেয়ে যেতে পেরেছে। এই সন্তান সঞ্জনার অস্তিত্ব নয় বরং রাজীবের জীবনের একটা অংশ এবং এই অংশকে কোনওদিন অবহেলা করার নয়, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল রাজীব।
রাজীবের মা-ও ছেলের এই পরিবর্তন ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। পুরোনো আগের সেই রাজীবকে ফিরে পেয়ে উনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এক সপ্তাহ সকলের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে রাজীব ফিরে এল মুম্বই।
সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকেছিল রাজীব। তখনই টের পেল বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বাথরোব পরে নিয়ে রাজীব বাইরে বেরিয়ে এল। যে-কেউই দরজায় থাক না কেন অপেক্ষা করতে রাজি নয় বেশ বুঝতে পারছিল।
দরজা খুলতেই দেখে অনসূয়া দাঁড়িয়ে, একপ্রকার রাজীবকে ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এল সে। রাজীব দরজা বন্ধ করতেই চেঁচিয়ে উঠল রাজীবের উপর।
কোথায় চলে গিয়েছিলেন? বলেও যাননি কিছু? ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। আপনার কোনও আইডিয়া আছে, আমার অবস্থা কী হতে পারে? চিন্তা করে কোনও কুল পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না তো? এমনিতে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন অথচ একবারও আমার চিন্তা আপনার মাথায় এল না? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনসূয়া।
সামান্য হেসে এগিয়ে এসে রাজীব অনসূয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এতদিনে ভালোবাসাও অনসূয়ার হৃদয়ের আঙিনায় জানান দিয়ে গেছে, আবার আসিয়াছি ফিরে।