এক গাদা সাংবাদিকের ভিড় মানেই কানের কাছে আজকাল মশা-মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পাই। প্রেস ক্লাবে পা রাখতেই ভনভনানিটা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল। বইয়ের প্রকাশ আর বিক্রির মধ্যিখানে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সালতামামি। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজন ছাড়াও প্রায় সবকটি বাংলা খবরের চ্যানেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। অথচ লেখিকা অপর্ণা ঘোষের এটি প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। কিন্তু এতে সবটা বলা হল না।

লেখিকা অপর্ণা ঘোষ মৃত স্বনামধন্য লেখক পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রী। যার অন্তত তিনটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগ্রন্থ দৈনিকের বেস্টসেলারের তালিকায় হামেশায়-ই দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে বছর দুয়েক আগে এই লেখকের মৃত্যুতে গোটা বাংলার সাহিত্যকুলকেই প্রায় গেল গেল রব তুলতে দেখেছিলাম। সামনের মাসেই পঙ্কজ ঘোষের জন্মদিন। যে-কাগজে কাজ করি, তার রবিবারের সাপ্লিতে পঙ্কজ ঘোষ সংখ্যা হবার কথা হয়ে আছে। ঠিক এই সময় পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রীর নিজের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ সংবাদেরই বিষয় বটে।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখনও শুরু হয়নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসরে প্রবেশ করবেন অপর্ণা ঘোষ। বেশ ব্যস্ত ভাবে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করছে সুদীপ্ত মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে পঙ্কজ ঘোষকে আপ্তসহায়তা করে এসেছে এই সুদীপ্ত মজুমদার। ঘোষ পরিবারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিল জানতাম। লেখকের স্ত্রী আবার ওকে নিজের জন্য পুনর্বহাল করলেন কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কামানো মুখ আর পাট ভাঙা হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজের মধ্যে প্রাণপনে একটা লেখক লেখক ভাব আনার চেষ্টা করছে সুদীপ্ত।

জেট নিউজের কৌশিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সামনের মুলোর মতো দাঁত দুটো বের করে মন ভুলিয়ে দেওয়া একটা এক্সপ্রেশন ঝাড়ল। যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ভাবে হাসিটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সদ্য ইলেকট্রনিক্স-এ জয়েন করার পরে নিজের মধ্যে একটা হামবড়াই ভাব এনেছে কৌশিক। তবে ওর দেঁতো হাসির উপহার সবাই পায় না। সম্পাদকীয় বিভাগে থাকলে কেউ কেউ ওর এই হাসি উপহার পায়। যেমন আমি।

এতজন মানুষের উপস্থিতিতে কিনা জানি না এসি-র কনকনে ঠান্ডা ভাবটাও শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না, যে-শীতল অনুভূতিটা পেতে চাইছিলাম। অপর্ণা ঘোষের সাক্ষাৎকার পর্ব কয়েকটা পয়েন্ট-এর আকারে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে আবার অফিসে। প্রতিবেদন আকারে সেটার পেজ সেটিং না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে কেমন করে যেন একঘেয়েমি ঢুকে পড়ছে।

একটু গুঞ্জন, তারপরই অপর্ণা ঘোষের প্রবেশ। সাদামাটা, হালকা ঘি রঙের তাঁতের শাড়িতে বিধবাভাবকে লুকোনোর কোনও চেষ্টা নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কাটা মুখে চোখ দুটো আমার নজরে এল। দামি রিমলেস চশমার আড়ালে সে চোখ বেশ উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমের মধ্যে আসতে হয়েছে, তাই বোধহয় তৃষ্ণা দূর করতে টেবিলের উপর রাখা জলের গেলাসের অনেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললেন।

আমি ছাড়াও, অনেকেই প্রস্তুত। মনেই হচ্ছিল সোজাসুজি কাজের কথায় যেতে বিশ্বাসী লেখিকা।

অনন্ত বার্তা দৈনিকের বিকাশ সেন-ই প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন। অপর্ণাদি, পঙ্কজবাবুর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। বেশ অবাক ঘটনা নয় কি?

বেশ সাবলীল ভাবেই উত্তর বেরিয়ে এল লেখিকার মুখ থেকে, আসলে সংসারের আকর্ষণটা তখন অনেক বেশি করে কাজ করছিল ভিতরে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় বেশ কিছুটা দিশাহারা লেগেছিল। একসময় আবিষ্কার করলাম সংসারের সেই ভয়ানক আকর্ষণটা যেন পেনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন পেন যেন সংসারকে প্রতিস্থাপন করল।

বিকাশদার পরবর্তী প্রশ্নের আগেই সান্ধ্য খবরের রমা ঘোষ ফায়ার করল, দিদি পঙ্কজবাবু বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটো গল্প এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে থাকলে আপনার এই বই প্রকাশ কতটা প্রাসঙ্গিক হতো?

অল্পক্ষণের জন্য লেখিকাকে স্মৃতিমেদুরতায় ডুবতে দেখলাম। কিছু বলবেন উনি। অপেক্ষা করছি আমরা। কার মোবাইল ফোন নিজের অস্তিত্ব জাহির করে বসল। পিছন ফিরে দু-একজন তাকাতে তড়িঘড়ি সেটি বন্ধ হয়। বাঁ হাতে রুমাল ধরে থাকা হাত নিজের মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন উনি, অনেকটাই। উনি যে-মানসিকতার মানুষ ছিলেন তাতে তো মনে হয় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়াটাই ওনার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।

আবার প্রশ্ন উড়ে এল, আচ্ছা ম্যাডাম এ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলি কি কোনও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত?

না-সূচক ঘাড় নাড়লেন অপর্ণা। না, লেখা অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছিল। আসলে লেখাগুলোর কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই বারবার এডিট করতে হচ্ছিল। বই যে করতে হবে সে ব্যাপারে চাপটা অবশ্য সুদীপ্তর তরফেই আসে, তৃপ্তি মেশানো এক মায়াময় হাসি ছুটে যায় সহকারীর দিকে।

নড়েচড়ে উঠি আমি। অস্বস্তিকর গরমটা কিছুতেই যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না। লেখিকা অপর্ণার সঙ্গে বারবার লেখক পঙ্কজের নামটা জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা এখানে যারা এই বই প্রকাশ কভারেজ করতে এসেছি, ঠিক কার কাছে এসেছি! লেখিকা অপর্ণার সত্তাটা স্বাধীন কিনা দেখে নেবার ইচ্ছা জাগছিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা এগিয়ে দিই, দিদি একটু অন্যরকম প্রসঙ্গ। লেখিকা অপর্ণা যদি পঙ্কজবাবুর স্ত্রী না হতেন তবে কি তাঁর বইপ্রকাশ ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের এই উচ্ছ্বাস থাকত?

মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন ওনার একটু ম্লান হয়ে এল। ক্লান্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, কী মন্তব্য করি বলুন তো? সেটা আপনারাই ঠিক করুন না।

রাতে অফিস থেকে যখন বেরোলাম, তখনও ঘুরে ফিরে লেখিকা অপর্ণার মুখটা আমার মধ্যে ফিরে আসছিল।

দুই

একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। রোববারের পাতার জন্য ফিচার চেয়েছিলাম পরিচিত এক লেখকের কাছে। সাবধানি চোখ নিয়ে তার জমা দেওয়া লেখাটা পড়ছিলাম। লেখার বাঁধুনিটা ভীষণ ভালো। কিন্তু প্যারাগ্রাফের চেঞ্জগুলো একদম ঠিকঠাক করতে পারেননি। সেগুলিকেই সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে যতটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

সামনে এসে দাঁড়াল অনিরূপা। বছর ২৭-এর মেয়েটি রবিবারের পাতার সম্পাদকীয় বিভাগে আছে প্রায় দেড় বছর। তারও আগের দু-বছর প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক ডেস্কে চাকরি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় এত কম বয়সে এই জ্ঞান খুব কম মেয়ের মধ্যে দেখা যায় অথচ কোনওরকম আঁতলামো নেই, উলটে এক নম্বর ফক্কড়। সাহিত্যলোকের এ সপ্তাহতেই প্রকাশিত সংখ্যাটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে চোখ দুটো বড়ো করে বলল, সৌম্যদা, এবার না তুমি খবর হয়ে যাবে।

নিজের হাতঘড়িটা কনুইয়ে দিকে একটু ঠেলে তুলে দিয়ে বলি, কেন রে!

অপর্ণা ঘোষের স্টোরিটা তুমি করেছিলে না?

হ্যাঁ, তো!

ভালো করে পড়ে দেখো এটা। চলে যায় অনিরূপা।

সাহিত্যলোকের বইয়ে আলোচনার বিভাগটা খুলে রেখে গেছে ও। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাজারে এই মুহূর্তে সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা অনেকগুলো। সদ্য প্রকাশিত বইগুলির আলোচনাও থাকে সে সমস্ত সংখ্যায়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহিত্যলোকের আলোচনা বিভাগটিকে অন্যরকম গুরুত্ব দিই। দীর্ঘদিন ধরে এই বিভাগটিতে লেখেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। লোকটার পড়াশোনা, বিশ্লেষণ এবং তথ্য পেশ করার ক্ষমতা চমকে দেবার মতো। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমালোচক কোনও লেখক বা বই সম্পর্কে যে মন্তব্য করবে, সেটা আমার মতো অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তার মতো ব্যক্তিত্ব যখন অপর্ণা ঘোষের লেখার সঙ্গে পঙ্কজ ঘোষের লেখার অত্যাশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর যাই হোক ধান ছড়িয়ে বুলবুলিতে খাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

স্টোরিটা করার সময় অপর্ণা ঘোষের বইয়ের দুএকটি গল্প পড়ে আমি কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, কোনও লেখিকার প্রথম গল্প গ্রন্থেরই ভাষা এত সাবলীল অথচ গভীর হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গোটা স্টোরিটাই তৈরি করেছিলাম একটু মুগ্ধ ভাব নিয়ে। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনার কোনও কোনও অংশ ব্যাঙ্গাত্মক তীর হয়ে যে আমার কাগজের রবিবারের স্টোরিটাকেও বিদ্ধ করেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর লেখার ধরনের মধ্যে মিল থাকা কি খুব অস্বাভাবিক! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার অনেক কিছুই তো অজান্তেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সাহিত্যলোকের আলোচনাটা যে অপর্ণা ঘোষের সদ্য শুরু হওয়া সাহিত্য জীবনকে অনেকটাই জটিল করে তুলবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

হাতের কাছে রাখা নিজের মোবাইল থেকে সান্ধ্য নিউজের রমাদি-কে ধরলাম। ভদ্রমহিলার লিটারেচার ফিল্ডের জ্ঞানটা যেমন গভীর তেমনি খবরও রাখেন নানারকম। প্রথমবার বেজে বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার ফোন করার সাথে সাথেই গম্ভীর অথচ সুরেলা গলা নিয়ে আমার কানের কাছে উঠে এলেন রমাদি। আমি সোজাসুজি আসল দরকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম, দিদি, সেদিন তো অপর্ণা ঘোষের বইয়ের লঞ্চিং-এ আপনিও ছিলেন। সাহিত্যলোকে এবারে যে-আলোচনাটা বেরিয়েছে চোখে পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ পড়েছে, সংক্ষিপ্ত, উদাসীন প্রতিক্রিয়া মনে হল আমার।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

কী আবার! গণেশবাবু যখন লিখেছেন তখন একটা কিছু ব্যাপার তো রয়েছেই।

আপনার কী মনে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।

কী বলি বলো তো! বেশ বিতর্কিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে পঙ্কজদার কিছু লেখা অপ্রকাশিত পড়েছিল। সেগুলোকেই এখন নিজের নামে চালানোর চেষ্টা চলছে। অপর্ণা চিরকালই সংসারিক মেয়ে কোনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও স্বামীকে সঙ্গ দিতে দেখিনি, অথচ পঙ্কজদা বরাবর নারীবাদের স্বপক্ষে কথা বলে এসেছেন।

সেন্ট্রাল এসি-র মধ্যে বসেও নিজের চারপাশে একটা গরম আবহাওয়ার বেষ্টনী পেলাম। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা আর একটু খুঁড়ে দেখা দরকার। ও প্রান্তে রমাদি অবশ্য আমার উত্তেজনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।

এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কী হবে সৌম্য! বাংলা সাহিত্যে লেখালিখিতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। সুদীপ্তর ফোন নাম্বারটা যতদূর মনে হচ্ছে ফোন বুকে তোলা আছে। একটু খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুরোধটা করতেই ওর মুখ থেকে যেন একরাশ বিরক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

কেন কথা বলতে হবে, কেন? অপর্ণাদি তার মতো লিখেছেন। আপনারা যেটা লিখবেন সেটাকেই কেন সবচেয়ে বড়ো সত্যি বলে মেনে নিতে হবে!

দেখুন সুদীপ্তবাবু, কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু কথাটা বোধহয় আমার সম্পর্কে খাটে না। বইটা পড়েই অপর্ণাদি সম্পর্কে আমার একটু অন্যরকম ধারণা হয়েছিল। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ একটা অ্যাপয়েনটমেন্ট…

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখছি।

সুদীপ্তর কন্ঠস্বরকে এতটুকু নরম মনে হল না!

তিন

মিনিট পনেরো হল চা-টা শেষ করেছি। দাঁত এবং মাড়ির আশেপাশে লেপটে থাকা বিস্কুটের স্তরটাকে জিভ চালিয়ে পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করছিলাম। ফুল স্পিড-এ মাথার ওপরে পাখা ছাড়াও পাশে থাকা সুপার স্পিড-এর স্ট্যান্ডফ্যানটা মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে যাচ্ছিল।

অপর্ণা ঘোষ উলটো দিকের সোফায় এসে বসেছেন বেশ কিছুক্ষণ কিন্তু এখনও অবধি মুখ খোলেননি। একই সোফার কোণে বসে আছে সুদীপ্ত। প্রশ্নগুলো মোটামুটি নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছি। রিডিং লাইটের আধা আলো আঁধারিতে লেখিকার মুখের ভাব ও মনের তরঙ্গের ঠিক হদিশ মিলছিল না। ঘোর লাগা গলায় একসময় সূচনাহীন এবড়োখেবড়ো প্রবন্ধ পড়ার ভঙ্গিমায় ওনার হঠাৎ করে বলতে শুরু করাটা আমাকে সচকিত করে দেয়। নিজের উরুর ওপরে প্যাডটা খুলে রাখাই ছিল। ডট পেনের পিছনটা আঙুল চালিয়ে টিপে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হই।

এত বছর পঙ্কজবাবুর সঙ্গে কাটানোর কারণেই কি তার অন্বয়রীতি, বাক্যবিস্তার, প্লট আপনার গল্পে গৃহীত হয়েছে? খুব ধীর গতিতে প্রশ্নটাকে ওনার সামনে রাখার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দেবার কোনও তাগিদ লক্ষ করলাম না ওনার মধ্যে। স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে পুনরায় ভেসে উঠতে চাইলেন তিনি। সত্যেন বোস লেনের মেসটাতে ও যখন থাকতে এল, তখনই ও ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনওদিনই সেভাবে মন ছিল না ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অফিসে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করছিল বটে কিন্তু সেভাবে কলকে পাচ্ছিল না। বেশ হতাশ। এইরকম একটা সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ইংরাজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। প্রথম দেখাতেই উদ্দাম প্রেম আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। একটি খবরের কাগজে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ও কলাম লিখত। একটু দম নেবার জন্য যেন থামতে চাইলেন অপর্ণা।

পরের প্রশ্নটা করব কিনা ভাবছি, এমন সময় পূর্ব প্রসঙ্গকে আরও টেনে বলতে শুরু করলেন অপর্ণা। তখন কাগজে ও যে-সব রিভিউগুলো লিখছে সেগুলোও সম্পাদকের ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। বেশ হতাশ ও। সংসার চলতে চাইছে না। সংসার ক্রমশ আমার কাছে বিভীষিকা তখন। এরই মধ্যে মোটামুটি একটি নামি পত্রিকায় আমার একটি গল্প বেরোয়। লেখাটি মোটামুটি প্রশংসিত হয়েছিল। আপনি ভাবছেন এসব কথা আপনাকেই বা কেন বলছি! আসলে এই মুহূর্তে অনেকেই যখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমার বিরুদ্ধে কলম চালাচ্ছে, তখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি সত্যিকথার অনুসন্ধান করেন। আর এত বছরে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে…।

সাদা সাংবাদিকতাকে কীভাবে হলুদ সাংবাদিকতা নিজের বশে এনে ফেলেছে তা এই কবছরে ভালোই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু অপর্ণা ঘোষের শেষ বাক্যটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ওনাকে বলি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কিন্তু কোথাও একটু গণ্ডগোল ঠেকছে। কোথাও একটা ফাঁক। একটা মস্ত বড়ো সত্যি যেন মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই ধোঁয়াশা আপনিই দূর করতে পারেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অপর্ণা। মুখ তুলে এরপর উনি সুদীপ্তর দিকে তাকাতে মুখে অল্প হাসি এনে সুদীপ্ত যেন ওনাকে কিছুর সম্মতি দেয়।

উনি বলতে শুরু করলে ওনার গলাটা আগের থেকে দৃঢ় শোনাচ্ছিল, ক্রিয়েটিভ রাইটিংটা কোনওদিন আপনাদের পঙ্কজদার আসত না। খেতে পাচ্ছি না অথচ রোজই ওর মুখে গালভরা স্বপ্ন শুনতাম। আর কখনও-কখনও রাতে বাড়ি ফিরে গায়ে হাত তুলত। অনেক বড়ো বড়ো সভায় গিয়ে সমাজে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতাই ও শুনিয়েছে। কিন্তু নিজের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে কী ব্যবহার করত আপনাদের সংবাদমাধ্যম কি তার খবর রেখেছে? আমার গল্পটা প্রশংসিত হবার পর আরও একটি গল্প লিখি এবং একটি নামি দৈনিকের রবিবারের পাতায় গল্পটি ওর নামে পাঠিয়ে দিই। আমার স্বামীকে এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতদিন পঙ্কজ ঘোষের নামে যা যা বেস্টসেলার পাবলিক জেনে এসেছে তার প্রতিটি অক্ষর আসলে আমার সৃষ্টি। দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন অপর্ণা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলাম। স্টোরিটা কীভাবে নিজের কাগজে প্লেস করব, এবার তার ভাবনা আমাকে ধাক্কা দেয়। খুব ধীর গলায় সুদীপ্ত বলে ওঠে, কিন্তু লেখার রীতিটা যে দিদির, সেটা বোধহয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়, না?

মৃদু হেসে বলে উঠি, কেন নয়? পঙ্কজ ঘোষের প্রবন্ধের ভাষা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা পরীক্ষা করে, আমার ধারণা একজন ভাষাবিদ অবশ্যই বলতে পারবেন। আর তা ছাড়া সত্যিটা প্রকাশিত হলে জনগণের সামনে একটা দুটো গল্প একজন জাত লেখিকা লিখে দিতে পারে। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি না।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এ বাড়িতে ঢোকার আগে সাক্ষাৎকার শিরোনাম কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিরোনামটা হঠাৎই মাথায় এসে যায়। নিজের ব্যাগ থেকে প্যাডটা বের করে ভুলে যাবার আগেই তা দ্রুত হাতে লিখে নিতে থাকি আমি…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...