ঘুড়ি উড়ছে। আকাশ ছেয়ে আছে ঘুড়িতে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রং-এর, নানা মাপের, নানা নামের, পেটকাটি, চাঁদিয়াল, বগ্গা, ভোকাট্টা, হাতে হাতে… কেউ নেবে?
মেরে না নাক ফাটিয়ে দেব। ছাড় বলছি।
সুতো যার, ঘুড়ি তার। সুতো আমি ধরেছি, ঘুড়ি তাই আমার…
না না, আমার ঘুড়ি। আমি আগে ধরেছি…
এইসব চিৎকার, সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজোর মাইকে হিন্দি গান ঊনিশে পা দেওয়া বিল্টুর মনেও দোল দিয়ে যায়। সময়টা বিকেলের দিকে, সূর্য অস্ত যেতে আরও খানিক্ষণ।
বিল্টু ঘুড়ি ওড়ায় না। কিন্তু ওড়ানোর নেশ তাকে টানে। ওই যে একটা ঘুড়ি কেটে সুতো এলিয়ে পড়ছে, তার পিছনে অনেক ছেলে ছুটছে। অনেক দিন আগের এই দৃশ্য বিল্টুর অন্ধকার চোখকে আরও ঘোলাটে করে, অন্ধকার আরও অন্ধকার। পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িটার একটা ঘরে হিস্ হিস্ শব্দ। ভুলও হতে পারে! তবু ভয়, সেঁটে থাকা এক কোণে।
ওরা আসছে, উন্মত্ত জনতা, পল্টুদার লোকজন, পল্টুদার কথায় ওঠে বসে। ওরা চাইলে বিল্টুকে খুনও করতে পারে। বিল্টু একা, ভীষণ একা। ওর দোষ রাত্রির ঘন-কৃষ্ণ চুলে, নদীর গতিপথ খুঁজে পেয়েছিল। ওই যে ওখানে, ধর শুযোরের বাচ্চাকে! পাড়ার মেয়ের ইজ্জত… ওদের হাতে ভোজালি। পল্টুদার হতে থ্রি নট থ্রি।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। সে দিন নামেনি বড়ো ভ্যাপসা গরম ছিল। একটু বৃষ্টি, বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে রাস্তা, ঘরবাড়ি। প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের বাড়িগুলো কেমন করে যেন বদলে গেছে এক বছরে। বিশাল ফ্ল্যাট, দোকান৷ এইখানে লতিফের বাড়ি ছিল। বিল্টুর বন্ধু, ডান গালে একটা তিল, ৫ ফুট লম্বা। কঞ্চির মতো বাঁকা লতিফরা কোথায়, জানতে খুব কৌতূহল হয়। এক টানা লম্বা দৌড়, এখনও ভোর হয়নি। বিল্টুকে আর দেখা যাচ্ছে না, দৌড়… দৌড়…
২
আর একটু পায়ে দিই তোকে। তুই তো কিছুই খেলি না। রাত্রির সাথে কী করে বিয়ে দিই বলত তোর! রাত্রির মায়ে এই কথায় বিল্টু লজ্জা পায়। রাত্রির দিকে তাকায়। রাত্রি হাসে, কী নির্লজ্জ! রাত্রির জন্মদিনে সেটা ছিল নিছকই ঠাট্টা, মজা।
মা মারা গেল, বিল্টুর মা। বাবা গেছে অনেক ছোটো বয়সে। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলে কোনও ভাবে। দারিদ্র, চরম দারিদ্র, কোনও রকমে নিজের পেট চালিয়ে নেওয়া। টাইফয়েড হল। সারা রাত বসে মাথার কাছে, মাথায় জলপট্টি, ওষুধ খাওয়ানো- রাত্রি ক্রমশ সুন্দর হয়ে ওঠে।
অন্ধকারও এত সুন্দর হয়! কী করে বিল্টু? কীভাবে রাত্রির যোগ্য করে তুলবে নিজেকে? ভালো রেজাল্ট করল, কলেজে ভর্তি হল। কলেজ ভালো লাগে না। সমস্ত মন জুড়ে রাত্রি। হা ঈশ্বর, তুমি কী নিষ্ঠুর! হিংস্র পশুর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে এই পৃথিবীর বাতাস দূষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে পোষিত এই জন্তুর দলই এখন সব। এদের হাতেই আজকের সমাজ, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র– রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলোই বলছিল বিল্টু।
আসলে এত কথা বলতে চায়নি সে। কিন্তু ভিতর থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এল। রাজনীতিতে যোগ দেবার পর এটাই বিল্টুর প্রথম ভাষণ। অনেক হাতাহাতি, দূরে পর্দা, চোখের চাহনিতে বিষ। পার্কে ওরা দুজন, সন্ধের অন্ধকার। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে পল্টুদার সাকরেদরা।
রাত্রিকে তুলে নিল ওরা, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। বিল্টুকে মেরে ফাটিয়ে দিল। কী করবে বিল্টু একা? ওরা অনেক। তাও বুকে ভর দিয়ে একটা আধলা ইট কুড়িয়ে নিল। লক্ষ করে ছুড়লও। একজন লুটিয়ে পড়ল। রাত্রিকে ছেড়ে দলটা বিল্টুর দিকে তেড়ে এল।
৩
ছোটো কাকার এক গুরুমা ছিলেন। সন্ন্যাসিনী মাথায় দীর্ঘ জটা, গেরুয়া শাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতের ত্রিশূলটি লাল সিঁদুরে লেপা, দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় হয়! তক্তাপোষের উপর উপবিষ্ট গেরুয়া বসনধারী গুরুমা, হাতের ত্রিশূলটি দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। বিল্টু একবার গুরুমাকে দেখে, একবার ত্রিশূল। গুরুমার দৃষ্টি এড়ায় না, কাছে ডাকল বিল্টুকে। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভয় কি তুইও যা আমিও তাই। সাহস রাখ মনে, তুই পারবি ঠিক পারবি।
বিল্টু খেয়াল করল কথাগুলো যেন গুরুমাকে দিয়ে কেউ বলাচ্ছেন। বিল্টু এ কথার কোনও মানে বুঝতে পারল না। শুধু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল গুরুমার দিকে।
৪
ছয় সাত বছরের একটি ছেলেকে ডাকলেন সন্ন্যাসী। তার হাতে একটি মিষ্টি দিলেন, অথচ ছেলেটি নিতে চাইল না। তার মা ইশারায় নিতে নির্দেশ দিতে সন্ন্যাসী মায়ের দিকে চাইলেন, প্রশান্ত দৃষ্টি, তারপর চোখ বন্ধ হল, ধ্যানমগ্ন হলেন সন্ন্যাসী। ঘরে ধূপ, ধুনো জ্বলছে, আধ্যাত্মিক পরিবেশ। সারা ঘরে ভর্তি পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অধিকাংশই নিমন্ত্রিত। সবার চেষ্টা সন্ন্যাসীর কৃপা পাওয়া! প্রসাদের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, ছাদের এক কোণে। প্যান্ডেল করে রান্না হচ্ছে। এক কথায় এলাহি আয়োজন। শুধু মজুমদারমশাই অনুপস্থিত৷ ব্যস্ত মানুষ তাঁর কী বসে থাকা চলে? অন্তত চারটে জায়গায় প্রোজেক্টের কাজ চলছে। ম্যানেজার আছে, সব তো আর ম্যানেজারকে দিয়ে হয় না, নিজেকে উপস্থিত থাকতে হয়। এছাড়া প্রোমোটিং ব্যাবসায় ছেলেদের থুড়ি, বখাটে ছেলেদের উৎপাত আছে। সেখানে মজুমদারমশাইয়ে উপস্থিতিই শেষ কথা।
সন্ন্যাসীর সৌম্য দর্শন, সারা মুখে প্রশান্তি, দাড়িতে আচ্ছাদিত। প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে আসে। গৃহকর্তার অনুরোধে তিনদিন থাকতে রাজি হয়েছেন সন্ন্যাসী। একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা। সন্ধের পর সবাই চলে গেছে, শুধু সন্ন্যাসীর ঘরে আলো জ্বলছে। তিনি জেগে পদ্মাসনে উপবিষ্ট। ঘরে কেউ প্রবেশ করল, অথচ সন্ন্যাসীর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। সন্ন্যাসী চোখ খুললেন, মুখে স্মিত হাসি, কে তুমি?
আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়, তুমি বিল্টুদা! কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ?
গৃহকর্ত্রীর চোখে জল, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একবার পিছনে দেখলেন সন্ন্যাসীর দুই চোখ মুদিত, যেন কিছুই ঘটেনি। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল সন্ন্যাসীর। না ঘুম হয়নি, শুধু চোখ বুজে থাকা। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে এখন অন্ধকার, সূর্যের আলো ফোটেনি। ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় সন্ন্যাসীর চুল অবিন্যস্ত।
ঘরে আর একজনের উপস্থিতি টের পেলেন। একটুও না ঘুরে সন্ন্যাসী বলে চলেন,
-আমাকে চিনে ফেলার পর আর আমার থাকা চলে না রাত্রি, আমি চলে যাই। সন্ন্যাসী হবার পর সব খবরই তোমার রেখেছিলাম, বিশ্বাস করো রাত্রি। তোমাকে দেখার বাসনা আমার হয়েছিল কিন্তু আমাদের তা হতে নেই। এই পৃথিবীর সবটাই পূর্ব নির্দিষ্ট। ঘটনাগুলো ঘটবেই। আমি যাই রাত্রি। এই কাগজটা রাখো। তোমার জন্যই রেখেছিলাম, দেওয়া হয়নি। এত বছর সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি, জানতাম তোমার সাথে দেখা হবে। ভালো থেকো রাত্রি।
মজুমদারবাবু উঠেছেন বেশ দেরিতে। উঠেই খবরটা শুনেছেন। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে গেছে! আত্মীয়স্বজন-কে একে একে জানিয়ে দিয়েছেন, সন্ন্যাসীর চলে যাওয়ার সংবাদ। তারপর রাত্রিকে পেলেন৷
-সন্ন্যাসীর ঘরে দেখা হল ?
প্রশ্নে ঘোর ভাঙল রাত্রির। বলল,
-তুমি জানতে?
-জানতাম, তাই তো নিয়ে এসেছিলাম। শুধু তোমার জন্য, বিশ্বাস করো, শুধু তোমার জন্য।
-আমাকে আরও কষ্ট দেবার জন্য!
কোনও কথার উত্তর না দিয়ে মজুমদারবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কাগজের ভাঁজ খোলে রাত্রি, তাতে লেখা
নক্ষত্রের চোখ শুধু ধাওয়া করে আমাকে, আমার রাত্রি…।
আর পড়তে পারছে না রাত্রি। দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।