হাউ ফ্যানটাস্টিক,  উদীয়মান সূর্য‌্যের দিকে তাকিয়ে বলল জয়িতা।

মি. দাস বিরক্ত হয়ে দেশলাই বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। একটাও কাঠি জ্বলছে না। কুয়াশার জন্য? কি বিচ্ছিরি কুয়াশা বটে। একটু আগেও ছিল না, এখন আবার হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। সূর্য‌্যটাও ঢাকা পড়ে গেল। যাকগে। একটা সিগারেট কি খাওয়া যাবে না?

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, খাবেন নাকি একটা? ডু ইউ স্মোক?

ওঃ, অফ্ কোর্স।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিল। সুমন বলল, আমাদের ভাগ্য কিন্তু ভালো, তাই না?

হোয়াই?

দেখলেন না কেমন কুয়াশা নেমে এল। আর একটু আগে নামলেই তো এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখা হতো না। কী বলেন?

কোন অসাধারণ দৃশ্যের কথা বলছ?

সানরাইজ মশাই!

হুঁ। তেমন অসাধারণ কিছু নয়। ম্যাল থেকেও এটা দেখা যায়।

দুটো কি এক হল?

প্রায় এক। সে যাই হোক। এটা দেখার জন্য এত ভোর ভোর উঠে এত দূরে ছুটে আসার কোনও মানেই হয় না।

তাহলে এলেন কেন?

মিসেস বলল,

খুব শোনেন বুঝি মিসেসের কথা।

একটু তো শুনতেই হয়।

আচ্ছা দেখি, আমার মিসেস আবার কোথায় গেল?

সুমন সরে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ততক্ষণে মলি এগিয়ে এসেছে। মলি ওর নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনে মিলে হনিমুনে এসেছে। সে এসেই সুমনের হাত ধরে বলল, তোমরা এখানে? ওঃ সিগারেট খাওয়া হচ্ছে। ফেলো ওটা। ওদিকটায় দ্যাখো খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দেখেছ, কেমন পাগলের মতো ছবি তুলছে সবাই। তারপরেই মি. দাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কটা ছবি তুললেন?

একটাও না।

কেন?

কারণ আমি পাগল নই। তাছাড়া সূর্য‌্যদেবকে ক্যামেরাবন্দি করার ইচ্ছেও নেই।

হাসল মলি। কথাটা খারাপ বলেননি তো!

সুমনও হাসল। বলল, উনি বলছিলেন এই একটা সূর্যদয় দেখার জন্য এত দূর ছুটে আসার কোনও মানে হয় না।

মলি ভুরু কোঁচকাল। তারপরেই বলল, খুব ভুল বলেননি কিন্তু। হাতের কাছেই কত ভালো জিনিস আমরা দেখি না। ওই যে রবিঠাকুরও বলেছিলেন না, কত দেশ ঘুরে কত ক্রোশ দূরে তার পরের লাইনটা বলো না।

মনে নেই, আমার কিন্তু এখন অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বেশ উঁচু গলায় আবৃত্তি করল সুমন,

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই মি. দাস?

আমি কবিতা পড়ি না।

যাঃ, কিন্তু এই কবিতাটা তো সব বাঙালির-ই জানা।

তোমার সঙ্গে বুঝি সব বাঙালির পরিচয় আছে?

মলি হাসল। ওর সঙ্গে তুমি ক়থায় পারবে না।

হঠাৎই কী মনে হতে সুমন মলির হাত ধরে টানে, আচ্ছা মি. দাস। আমি একটু ওকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরে আসি। আপনি থাকুন বরং। ডোন্ট মাইন্ড।

মাইন্ড করব কেন? তুমি তোমার বউকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছো। আমাকে তো নয়?

দুজনে এগিয়ে গেল।

জয়িতা ওখানে কী করছে?

মি. দাস এগিয়ে গেলেন।

জয়িতা, সরে এসো, খাদের পাশে দাঁড়িয়ো না।

সরে দাঁড়াল জয়িতা।

কী করছিলে ওখানে?

কুয়াশা দেখছিলাম। কত নীচ থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, সুন্দর না?

কুয়াশা হামাগুড়ি দেয় না আর দাঁড়াবে না খাদের পাশে।

জয়িতা ঘাড় নাড়ায়, আচ্ছা।

গাড়ি নামছে টাইগার হিল থেকে। হঠাৎ করেই ব্রেক কষে। পাশেই একটা ভিড় জমেছে। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা শোনা গেল।

সুমন ও মি. দাসরা একই গাড়িতে ফিরছিল। গাড়ির ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল ব্যাপারটা। পেছন পেছন সুমনও নামল।

একটু পরেই ফিরে এসে সে বলল, হরিবল্ ব্যাপার বুঝলেন? মুখোমুখি দুটো গাড়ির ধাক্কা। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। মাথা ছাতু হয়ে গেছে। আর একজন গুরুতর ভাবে জখম। একটা পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

মলি শুনেই দেখতে ছুটল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল বিবর্ণ মুখে।

ইস্, লোকটার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে না দেখলেই ভালো করতাম।

দেখতেই তো গেছিলেন বিরস মুখে বললেন মি. দাস।

জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা, লোকটাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিলে হয় তো।

তার মানে! চোয়াল ঝুলে গেছে সুমনের।

আপনি বললেন না জখম হয়েছে? ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।

সেটা হয় নাকি একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মাথা নাড়ে সুমন, এটা পুলিশের কেস্। আর স্থানীয় লোকেরা তো আছেই। দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

মি. দাস আপন মনেই বিড়বিড় করলেন, বাইস্ট্যান্ডারস এফেক্ট।

কী বললেন?

কিছু না ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট করো।

যেতে যেতে মলি বলল, জয়িতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছিল। হাসপাতালে এক্ষুণি নিয়ে গেলে হয়তো…

মি. দাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, সুমন বলছিল লোকটার পা চলে গেছে। এভাবে না বাঁচাই ভালো।

অদ্ভুত মানুষ আপনি, মলি ভুরু কোঁচকায়।

পথে তেনজিং পযে্ট দেখে একটা বড়ো গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের গাড়ি। ওরা নামে।

গুম্ফাটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। সুন্দর জায়গাটা। গুম্ফার পাঁচিল থেকে অনেক দূর পর্য়ন্ত দেখা যায়। জয়িতা আরেকবার বলে ফেলল, ফ্যানটাস্টিক।

এর পরেই অবশ্য হতাশ হতে হল ওদের। মূল প্রার্থনা ঘরটা বন্ধ। বোধিসত্ত্বের মূর্তিটা দেখা যাবে না। দশটার আগে দরজা খোলে না। এখন সবে সাতটা বাজে।

পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে সুমনরা কয়েকটা ছবি তুলল। মি. দাসকে বলল, ওদের দুজনের ছবি তুলে দিতে।

প্রার্থনা-মন্দিরটার পাশেই একটা ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাচ্চা লাল আলখাল্লা পরে ঘুরছে। একজন একটা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুরের সঙ্গে খেলা করছে।

জয়িতা জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা?

দে আর লিটল্ লামা বুদ্ধিস্ট মংকস্।

সুমন হেসে বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? অবশ্য, আমাদের ভাষা ওরা বোধহয় বুঝবে না।

সো কিউট্ দে আর। ভুরু কোঁচকায় জয়িতা, এত ছোটো বয়সে সন্ন্যাসী হয়?

দেখছেনই তো হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলুন?

কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় জয়িতা। তার ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চার দিকে। এই বাচ্চাটাই একটু আগে কুকুরের সঙ্গে খেলছিল।

কী দেখছেন এত মন দিয়ে সুমনের গলায় কৌতূহল।

দেখুন না, ওর হাতে একটা পোকা বসে আছে, কামড়াচ্ছে মনে হয়। ও কিন্তু ওটা ফেলে দিচ্ছে না। চুপ করে দেখছে পোকাটাকে। অদ্ভুত না!

সুমনও ব্যপারটা দেখল। ততক্ষণে আর একটা বাচ্চা, এ একটু বড়ো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। পোকাটাকে খুব সাবধানে, যেন সযত্নে তুলে সে পাশেই একটা উঁচু জায়গায় রেখে দিল।

ওঃ… এরা তো বৌদ্ধ, তাই বোধহয় সুমন বলল।

এখানে কী করছ? মি. দাস এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুমন পুরো ঘটনাটা শুনিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মিসেস কিন্তু বেশ ইনকুইজিটিভ। ছোটো ছোটো ব্যপারও ওঁনার চোখ এড়ায় না।

মেযোনুষ যে, ঘাড় ঝাঁকালেন মি. দাস। চলো এবার কিছু দেখার নেই এখানে।

বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে ছিল জয়িতার। কিন্তু আর কিছু না বলে ফেরার পথ ধরল।

হোটেলে ফিরে সুমন ও মলি রেস্ট নিচ্ছে। টিভি চালিয়েছে। হঠাৎ করেই মলি বলল, মি. দাস লোকটা যেন কেমন, তাই না?

হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত বটে।

অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভাবো। কোনও রিঅ্যাক্ট করলেন না!

সে তো সানরাইজটাই উনি ভালো করে দেখলেন না। অথচ লোকে ওটা দেখতেই… আমি সিগারেট খাওয়ালাম দুতিনবার কিন্তু উনি একবারও আমাকে অফার করলেন না। ভাবো!

আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ঘুরলাম, উনি নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি। এটা খেয়াল করেছ? আমারাই শুধু যেচে আলাপ করেছি।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক সামাজিকতার ধার ধারেন না। কাঠ কাঠ আচরণ।

হ্যাঁ, কেমন যেন রোবট রোবট।

হয়তো সত্যিই উনি একটা রোবট! হাসতে হাসতে বলে সুমন।

শোনো না স্বামীর পাশে ঘন হয়ে আসে মলি। আমারও কিন্তু তা-ই মনে হচ্ছে।

কী মনে হচ্ছে?

হাসি নয়। সেদিন খবরের কাগজে পড়লাম না রোবোট কোম্পানিগুলো এখন অবিকল মানুষের মতো দেখতে যান্ত্রিক এসকর্ট তৈরি করছে। কোনও সঙ্গীহীন লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে। যাচ্ছেও অনেকে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু।

তোমার মাথায় আসেও বটে! রোবট কি সিগারেট খায়?

সিগারেট ধরাচ্ছিল কিন্তু ইন করছিল না আমি লক্ষ্য করেছি।

বাঃ, বেশ খুঁটিয়ে দেখেছ দেখি ওকে। মনে ধরেছে বুঝি?

ঠাট্টা কোরো না, ভদ্রমহিলার আই মিন জয়িতাদির দেখেছ মাথায় সিঁদুর নেই। স্বামী মারা গেছেন হয়তো।

আর তাই একটা রোবট ভাড়া করে দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছেন, তুমি গল্প লেখা শুরু করে দাও বুঝলে। ভালো কল্পনাশক্তি আছে।

তুমি তো আমার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছ! হতে পারে না বুঝি এরকম?

পারে, পারে সব হতে পারে মলিকে কাছে টানে সুমন। তার রাগ রাগ মুখে একটা চকাস করে চুমু খেয়ে বলে,নতুন বউ চাইলে এই হোটেলটাও তাজমহল হতে পারে, আর আমি হতে পারি সম্রাট শাজাহান… ঠোঁটটা দাও না।

আঃ, আমার মুড নেই এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মলি। জয়িতাদির কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

কেন? একটু ক্ষুণ্ণ সুরেই বলে সুমন, ভালোই তো আছেন মহিলা। সারাক্ষণ হাসছেন।

ওটা জোর করা হাসি। তোমরা ছেলেরা বুঝবে না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মলি। বলে এত প্রাণবন্ত মহিলা, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু সঙ্গীহীন রোবট কি আর মানুষের একাকিত্ব ঘোচাতে পারে। তার ওপর ওরকম গম্ভীর একটা রোবট!

যাঃ, তুমি সত্যিই ভাবছ নাকি উনি একটা রোবট!

রোবট যদি না হয়, তাহলে তো লোকটাকে আরও-ই সহ্য করা যাবে না। রবিঠাকুরের কবিতাও লোকটা জীবনে পড়েনি। ভাবা যায়!

 

রাত দশটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়েছেন মি. দাস। জয়িতা ঘরে ঢুকল। একটা গোলাপি রঙের হাত কাটা নাইটি পরেছে। স্বচ্ছ পোশাকটার ভেতরে তার পরিপূর্ণ শরীর কুয়াশা ঢাকা চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।

মি. দাসের পাশে এসে জয়িতা বসল। মি. দাসের গায়ে হাত রেখে বলল, চলো ঘুমোই।

আর একটু পরে, মি. দাস বললেন।

জয়িতা একটু ঝুঁকে মি. দাসের ঠোঁটে একটা আলতো করে চুমু খেল। তারপর তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখল।

হাত ছাড়ো জয়িতা, আমার ভাল্লাগছে না।

জয়িতা হাতটা ছেড়ে দিল। মনোযোগ দিয়ে একটা একটা করে মি. দাসের জামার বোতাম খুলতে লাগল।

আঃ, কী করছ? এক ঝটকায় জয়িতার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন মি. দাস।

জয়িতা তাকিয়ে আছে। তার ভুরুটা একটু কুঁচকেছে। যেন কিছু একটা জিনিস তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু চুপ থেকে সে আবার হাত বাড়াল। মি. দাস একটা পাজামা-প্যান্ট পরেছিলেন, সেটা ধরে টেনে নামিয়ে দিল জয়িতা।

ইউ ডার্টি গার্ল, প্যান্ট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালেন মি. দাস। রাগ রাগ মুখে জয়িতার গলার পেছনে একটা বিশেষ অংশে দুই আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিছানার ওপর ঢলে পড়ল জয়িতা। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসাড় শুয়ে আছে।

যেমন নিঃসাড় আমার এই পা টা, নিজের মনেই বললেন মি. দাস। পাজামার ওপর দিয়ে নিজের কৃত্রিম ডান পা-টার ওপর সস্নেহে ধীরে ধীরে হাত বোলালেন। জয়িতার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বেচারি। ওর তো কোনও দোষ নেই। রাত হলেই ক্লায়েন্ট কে ও সেক্সুয়াল সার্ভিস দেবে। এভাবেই ওকে প্রোগ্রাম করা আছে।

নিজের মনেই একটু হাসলেন মি. দাস। সানরাইজ দেখে, কুয়াশা দেখে কেমন সুন্দর মুগ্ধ হবার ভান করে মেয়েটি। যেমন তিনি ভান করছেন একটি স্বাভাবিক সুস্থ, মানুষের মতো বাঁচার…

নীচু হয়ে জয়িতার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিলেন মি. দাস। তারপর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...