রোটারি সদন প্রেক্ষাগৃহে সম্প্রতি পরিবেশিত হল ‘ভাবাঞ্জলি’। নৃত্যানুষ্ঠানটির নিবেদক ছিল ‘সৃজন ছন্দ ‘।
ভাবাঞ্জলি-র মূল উপজীব্য বিষয় ছিল গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ঘরানার ঐতিহ্যপূর্ণ খাঁটি নৃত্যশৈলীকে আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রলেপে দৃষ্টি নন্দন করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা। যাতে, তারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই প্রাচীন শাস্ত্রীয় নৃত্যের ঐতিহ্য প্রচার এবং প্রসারে সহায়ক হয়। অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয় সংস্থার উপ সভাপতি ড. কৌশিকী চক্রবর্তীর বক্তব্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথির আসন গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায় এবং কত্থক নৃত্যশিল্পী গুরু অসীমবন্ধু ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে এই সংস্থার কলা কূশলীরা প্রদর্শন করলেন তাণ্ডব ও লাস্য আঙ্গীকে স্থাপত্য অঙ্গ বিলাস। মন্দির গাত্রে বর্ণিত প্রাচীণ স্থাপত্য কলার নিদর্শন স্বরূপ সুচারু দেহ ভঙ্গিমাগুলোকে নৃত্যের মাধ্যমে তাল, লয় ও ছন্দ সহযোগে সুনিপুণ ভাবে পরিবেশন করা হয় এই স্থাপত্য অঙ্গবিলাস নৃত্যাংশটিতে। আদি তাল এবং ইমন রাগাশ্রিত নৃত্যাংশটির নৃত্য নির্মাণে ছিলেন সৃজন ছন্দ’-র কর্ণধার শ্রী রাজীব ভট্টাচার্য। সঙ্গীত রচনায় ছিলেন শ্রী দেবাশিষ সরকার।
পরবর্তী নৃত্যাংশটি ‘মা সরস্বতী সারদে’ । রাগ ভীমপলশ্রী এবং একতালি আধৃত অপূর্ব এক বিরল সঙ্গীত সহযোগে সরস্বতী বন্দনা দর্শকদের মুগ্ধ করে।
এরপর রাগ শিবরঞ্জনি এবং একতালি আধৃত তাণ্ডব লাস্য নৃত্যাংশটির মনোরম দলগত উপস্থাপনা প্রশংসার দাবি রাখে।
ওড়িশি নৃত্যে অভিনয় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘শুন মন হরি কা নাম’ এই সঙ্গীতাংশটির সঙ্গে গুরু শ্রী রাজীব ভট্টাচার্যের পরিশীলিত ও পরিমার্জিত নৃত্যাভিনয় দর্শকমন আপ্লুত করে। পরবর্তী নৃত্যাংশটিতে সংস্থার কুশলীরা পারদর্শীতার সঙ্গে আধ্যাত্মিক প্রেমের মাধ্যমে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন বর্ননা করে ‘গোবিন্দ ধাম’ এই অভিনয় অংশটির মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সরস্বতী বন্দনা, জটাটবী এবং ‘গোবিন্দ ধাম শুন সখী’ এই তিনটি সঙ্গীতাংশ প্রথাগত ওড়িশি সঙ্গীতাংশ থেকে ভিন্ন স্বাদের উত্তরভারতীয় সঙ্গীতাংশ যার সঙ্গে খাঁটি ওড়িশি নৃত্যের মেলবন্ধন ‘ভাবাঞ্জলি’-র অন্যতম বিশেষত্ব। প্রথমার্ধের শেষ পর্বে পরিবেশিত হয় কীভাবে অশুভ শক্তির বিনাশপূর্বক ব্রহ্মান্ডে সাম্যাবস্থা পুনরুদ্ধার করছেন। তাণ্ডব অঙ্গ পরিবেশনায় কুশলীদের পারদর্শীতা দর্শকদের নজর কাড়ে। প্রথমার্ধের নৃত্যানুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন তৃষা দাস, রঞ্জাবলী দে , সৃঞ্জয়ী ছেত্রী, অঙ্গনা বোস, কমলিকা বোস, শালিনী সিনহা, সৌমেন কুণ্ডু, সুরজিৎ বিশ্বাস এবং শ্রী রাজীব ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে সৃজন ছন্দ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবীন সম্ভবনাময় শিল্পীদের একক পরিবেশনা সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে বর্নময় করে তোলে।
প্রথম পরিবেশনায় দেবদত্তা মান্না উপস্থাপন করেন ‘মাতঙ্গি ধ্যানম’। দেবদত্তা তার সাবলীল নৃত্যভঙ্গিমায় জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাতঙ্গির রূপ বর্ননা করেন। রাগ মালিকা এবং যোতি ও আদি তাল আধৃত এই নৃত্যাংশটির নৃত্য নির্মিতিতে গুরু রতিকান্ত মহাপাত্র এবং সঙ্গীত নির্মিতিতে শ্রী প্রদীপ কুমার দাসের নাম উল্লেখ্য।
দ্বিতীয় পরিবেশনায় একতালি এবং মোহোনা রাগাশ্রিত স্থায়ী বটু উপস্থাপিত হয় ঐশী ঝা এর ছন্দবদ্ধ পদসঞ্চালনার মাধ্যমে।
ওড়িশি নৃত্যে পল্লবী একটি আকর্ষনিয় অধ্যায় যা বিভিন্ন রাগের নামানুযায়ী নামাঙ্কিত হয় এবং ধীর গতি থেকে শুরু হয়ে মধ্য ও দ্রুত লয়ে ক্রমবিকশিত হয়। সায়ন্তনী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘মেঘপল্লবী’ পরিবেশনা দর্শকদের ভালো লাগে। ঝম্পা তাল এবং মেঘ রাগাশ্রিত এই পল্লবীটির নৃত্য নির্মাণ করেন গুরু রতিকান্ত মহাপাত্র।
এরপর সৃজিতা মুখোপাধ্যায় পরিবেশন করেন ‘সাভেরি পল্লবী’। লাস্য আঙ্গিকে তার পরিবেশনা বেশ ভালো লাগে। একতালি সহযোগে সাভেরি রাগাশ্রিত এই পল্লবীটির নৃত্য নির্মাণ করেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র। সঙ্গীত রচনা করেন পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্র।
অনুষ্ঠানের সর্বশেষ নিবেদনটি ছিল আরাভি পল্লবী। সিনড্রালা কর্মকারের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা দর্শকমন তৃপ্ত করে। আদি তাল এবং আরাভি রাগাশ্রিত নৃত্যাংশটির সঙ্গীত রচনা করেন পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্র, নৃত্য নির্মাণ করেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র। ‘ভাবাঞ্জলি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটির মূল ভাবনা এবং পরিচালনায় ছিলেন সৃজন ছন্দের কর্ণধার শ্রী রাজীব ভট্টাচার্য। সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য যাদের নাম উল্লেখ্য, তারা হলেন— মেসার্স অল এন্ড কোম্পানি কলকাতা, দেবজ্যোতি মান্না, অবন্তিকা মান্না, সুমনা দাস ভট্টাচার্য, উপাসনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন বোস এবং ইমন বোস।