সুচিত্রা কিছুতেই মনের আনন্দ গলার স্বরে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না সেটা ফোনের মধ্যেও বুঝতে পারছিলেন সুনন্দাদেবী।

কী বউমা, এত সকালে তোমার ফোন? কোনও ভালো খবর আছে বুঝি? সুনন্দা উৎসুক কণ্ঠে ফোনের ওপারে থাকা সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ মা, তুমি এবার ঠাকুমা হতে চলেছ।

বউমা, সত্যি বলছ? সত্যিই আমি এবার ঠাকুমা হব? আমি ভাবতে পারছি না, সকাল সকাল এরকম একটা আনন্দের খবর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। কবে থেকে এই খবরটা শুনব বলে বসে আছি। সকালবেলাতেই তুমি আমার মন ভালো করে দিলে। ভালো থাকো, সুখে থাকো। সুনন্দাদেবী আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে বউমাকে বললেন।

হ্যাঁ মা…, আশ্বাস দিল সুচিত্রা।

আমি জানি নাতি আসতে চলেছে আমার। তা তোমার মা-কে খবরটা জানিয়েছ? উনিও শুনে খুব খুশি হবেন। সুনন্দা মনে করান বউমাকে।

না! তোমার সঙ্গে কথা বলেই মা-কে ফোন করব। কিন্তু একটা কথা বলো তো, নাতি-ই যে আসতে চলেছে সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত কী করে হলে? নাতনিও তো আসতে পারে। হেসে উত্তর করে সুচিত্রা।

না না, আমি জানি আমার ঘরে প্রথম নাতিই আসবে, আসতেই হবে। কিন্তু বউমা তুমি নিজের যত্ন করবে। ভারী ওজনদার জিনিস এখন একদম তুলবে না। তোমার কাজের মেয়েটা ঠিকঠাক আসছে তো? সুনন্দার চিন্তা ওনার গলার আওয়াজেও প্রকাশ পায়।

তুমি একদম চিন্তা কোরো না। রীণা রোজই কাজে আসছে। এখন ছুটি নেওয়াটাও ওর অনেক কমেছে। শাশুড়িকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে সুচিত্রা কথাগুলো বলে।

এখন ওকে একেবারেই ছুটি দিও না। এই সময় তোমার বিশ্রাম করাটা খুব দরকার। বিশেষ করে শুরুর সময়টা এবং শেষের তিনটে মাস খুবই সাবধান।

হ্যাঁ মা, আমি জানি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি নিজের খেয়াল অবশ্যই রাখব। বলে সুচিত্রা ফোন কেটে দিল।

আগের দিনই সুচিত্রা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছে নিজের প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে। সকালে অজয় অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের পরিচিত গাইনির কাছে গিয়ে একবার পরীক্ষা করিয়ে কনফার্ম হয়ে, অজয়কে ফোনে ব্যাপারটা জানিয়েছে।

আজকে তাই সকালে উঠেই প্রথমে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার পর মা-কে ফোন করল সুচিত্রা।

মা, একটা ভালো খবর দিতে চাই।

ভালো খবর? আমার দিদা হওয়ার খবর নাকি? অনিমা নিজের মনেই মুচকি হাসলেন।

তুমি কী করে জানলে আমি এই খবরটা দিতেই ফোন করেছি? অন্য খবরও তো হতে পারত। এই যেমন অজয়ের প্রোমোশন…, চুপ করে যায় সুচিত্রা।

শোন চিত্রা, আমি তোর মা। তোর গলা শুনেই বুঝেছি কী ভালো খবর তুই দিতে চলেছিস। আমি প্রচণ্ড খুশি হয়েছি। ভাবতে পারছি না আমার সেই ছোট্টা চিত্রা আজ তারই মতো সুন্দর একটা মেয়ের মা হতে চলেছে। দেখবি তোর মেয়ে নিজের দিদার মতোই বুদ্ধিমতী এবং তোর মতো সুন্দরী হবে। গর্বিত কণ্ঠে অনিমা বলেন।

মা, তোমারও না সবেতে বাড়াবাড়ি। তুমি কী করে এতখানি শিয়োর হচ্ছ যে তোমার নাতনিই হবে? কপট ধমক দেয় সুচিত্রা নিজের মা-কে।

চিত্রা, আমার মন বলছে দেখিস। আর আমিও চাই তোর ফুটফুটে একটা মেয়ে হোক। এখন ফোন রাখ, আমি তোর বাবাকে সুখবরটা দিয়ে আসি।

 

প্রেগন্যান্সির প্রথম দেড়-দু’মাস সুচিত্রার শরীর প্রায়শই খারাপ থাকত। বমি ভাব, খাবার দেখলেই অনিচ্ছা, অরুচি, মাথা ঘোরা এসব লেগেই থাকত। এই সময়টা অজয় ছুটি নিয়ে প্রায়শই বাড়িতে থেকে যেত সুচিত্রার খেয়াল রাখার জন্য। কাজের মেয়েটিও যথেষ্ট খেয়াল রাখত বউদির।

এরপর আস্তে আস্তে সুচিত্রার শরীর নতুন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে শুরু করল। তখন সুচিত্রা নিজেই নিজের যত্ন নিতে তৎপর হল যাতে অজয়ের উপর বেশি চাপ না পড়ে। ও যখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন একদিন বারান্দায় চেয়ারে বসে প্রকৃতির শোভায় নিজেকে মগ্ন করে রেখেছিল সুচিত্রা। হঠাৎ-ই গাড়ির আওয়াজে চোখ চলে গেল ফ্ল্যাটের মূল ফটকের বাইরে। দেখল মা গাড়ি থেকে নামছেন। সঙ্গে ব্যাগ এবং মাটিতে নামানো একটি সুটকেস। তার মানে সুচিত্রা বুঝল মা ওর কাছে থাকতেই এসেছেন। রীণাকে ডেকে তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে পাঠাল সুচিত্রা, সুটকেসটা নিয়ে মা-কে সঙ্গে করে আনার জন্য।

রীণার সঙ্গে অনিমা ফ্ল্যাটে ঢুকে এলে আনন্দে মা-কে জড়িয়ে ধরল সুচিত্রা। মা, তুমি কী করে আসতে পারলে? তোমার ক্লাস নেওয়ার কী হবে? তুমি এখানে থাকলে কলেজের ক্লাস কী করে নেবে? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল মা-কে সুচিত্রা।

দাঁড়া দাঁড়া একটু বসতে দে, তারপর তোর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। বলে অনিমাদেবী হাঁফাতে থাকেন। শেষ তিনদিন নিজের সংসার গুছিয়ে প্ল্যান করতে গিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাননি। মেয়ের কাছে পৌঁছে এখন নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে মেয়েকে সম্বোধন করে বললেন, ওদের ক্লাস নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। এখন তো সব ক্লাস অনলাইনেই হচ্ছে। তাই ভাবলাম, এই সময়টা চিত্রা তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। সুচিত্রা আনন্দে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।

খুব ভালো করেছ মা এখানে চলে এসে। অজয় অফিস চলে গেলে আমার একটু ভয় ভয়ই করে। খালি মনে হয় কোনও একটা এমারজেন্সি হলে কী করব। রীণা যদিও অজয় আসা অবধি আমার কাছেই এখন থাকছে। অজয় ফিরলে তবে ও বাড়ি যায়।

সন্ধেবেলায় অজয় বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে দেখে খুব খুশি হল। সারাদিন বাইরে কাজে থাকতে হয়, সুতরাং সুচিত্রা-কে নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। শাশুড়ি এসে যাওয়াতে ও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল। সুচিত্রারও আনন্দের কোনও শেষ ছিল না। ও জানত মা ওর কাছে থাকা মানে রোজ মায়ের হাতের খাবার খাওয়া যাবে।

মা আসার পর ১০ দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। অনিমাদেবী গর্ভবতী মেয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের খাবার বানাতেন। সুচিত্রা যখন তাঁর গর্ভে তখনকার গল্প শোনাতেন। মেয়ের শরীর ভালো রাখতে কিছু কিছু কাজও মেয়েকে দিয়ে করাতেন। সুচিত্রার দিনগুলো ভালো ভাবেই কাটতে লাগল। অনিমাদেবী নিজে যথেষ্ট শিক্ষিতা। কলেজের লেকচারার, ফলে ডিসিপ্লিন মেনে চলতেন নিজেও এবং আশা করতেন অন্যরাও সেটা মেনে চলবে। সুচিত্রার চরিত্র যদিও মায়ের বিপরীত, তবু মা-মেয়ের ভালোবাসার বন্ধনে কোনও খামতি অনিমাদেবী রাখেননি। দিনগুলো বেশ কাটতে লাগল।

সময় কেটে যাচ্ছিল। সুচিত্রার শরীর ভারী হয়ে উঠল। আগের মতো লাফালাফি করে কাজ করতে আর পারে না। কিন্তু মা সঙ্গে থাকাতে কোনও দুশ্চিন্তা হতো না। অনিমাদেবীও মেয়ের বিশ্রামের পুরো খেয়াল রাখতেন।

এরই মধ্যে একদিন অজয়ের মা ছেলেকে ফোন করলেন বউমার খোঁজ নিতে। অজয়, আমি আসছি তোদের ওখানে। নাতিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।

কিন্তু মা, তোমার নাতি এখন কোথায় এসেছে? কৌতুকের ভঙ্গিতে অজয় বলে।

দূর পাগল ছেলে… এখন আসেনি ঠিকই কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তো আসতে চলেছে। গর্ভে থাকা অবস্থায় যদি নাতির সেবা না করি তাহলে ও-ই বা কেন আমাকে ঠাম্মা বলে মেনে নেবে? যা, ফোন রাখ আমাকে প্যাকিং করতে হবে। বলে ফোন কেটে দিলেন সুনন্দা।

 

সপ্তাহের শেষে সুনন্দা ছেলের বাড়ি পৌঁছোলে অনিমাদেবী আর সুচিত্রা স্বাগত জানাল ওনাকে। অজয়ের মা-ও অনিমাদেবীকে জড়িয়ে ধরলেন, ভালোই হল অনিমা, তোমার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাতে পারব।

উপরে উপরে দুই বেয়ানের ভাব-ভালোবাসার কথা হলেও ভিতরে ভিতরে দুজনেরই মনে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। তার প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল কিছুদিন পর থেকেই।

অনিমাদেবীর বরাবরই অভ্যাস ভোর পাঁচটায় উঠে পড়া। সুচিত্রার কাছে আসা থেকেই মেয়েকে নিয়ে ভোরবেলা সামনের পার্কে আধঘন্টা হেঁটে আসতেন। সুচিত্রারও ভালো লাগত। সারাদিনটা খুব ফ্রেশ মনে হতো নিজেকে। সুনন্দাও কয়েকদিন এসব দেখে অনিমাদেবীর আগেই ভোরে উঠে পড়া শুরু করলেন। সুচিত্রাকে ডেকে তুলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় আসন শিখিয়ে বলে দিলেন, ভোরবেলায় বাইরে হাঁটার বদলে আসনগুলো করলেই সুচিত্রার এই অবস্থায় বেশি উপকার হবে। এদিকে অনিমাদেবীও মেয়েকে জোর করতেন পার্কে হাঁটার জন্য।

সুচিত্রার হতো মুশকিল, কার কথা শুনবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। এদিকে অনিমাদেবীও বেয়ানের এই দখলদারি অপছন্দ করতে শুরু করলেন। একদিন ধৈর্য হারিয়ে একটু রূঢ় ভাবেই বলে ফেললেন, বেয়ান, চিত্রা তো আমার মেয়ে আমি ওকে এই ভোরেই হাঁটতে নিয়ে যাব। আপনি বরং ওর আসন করার সময়টা বদলে দিন।

সুনন্দাও দমবার পাত্রী নন, কঠোর স্বরেই বললেন, কিন্তু অনিমা তুমিও বুঝতে চাইছ না, আসন করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমিও অজয় পেটে থাকতে শাশুড়িমায়ের কথামতো যোগব্যায়াম করতাম। এর ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ! হেলদি ছেলে জন্মেছে, আজ যে-তোমার জামাই। বাধ্য হয়ে সে এবারের মতো অনিমাদেবীকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়।

সুচিত্রার মুখে সব শুনে অজয় নিজের মা-কে বোঝাল, মা সকালেই বরং সুচিত্রা পার্কে হেঁটে আসুক কারণ তখন পার্ক ফাঁকা থাকে। তুমি বিকেলে সুচিত্রাকে দিয়ে আসনগুলো করিও। বিকেলে ওর ভরপুর এনার্জিও থাকে। দুই বেয়ানের সম্পর্ক ভালো রাখার এই প্রয়াসে অজয় তখনকার মতো জয়ী হলেও, জয়ের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না।

অনিমাদেবী সুচিত্রাকে যেটাই করতে বলতেন, অজয়ের মা ঠিক বিপরীত একটা কিছুর উপদেশ দিতেন। অথচ দুজনেই সুচিত্রার ভালোর জন্য বললেও উদ্দেশ্য একে অপরকে নীচু করা এবং নিজেকে উপরে রাখা। সুচিত্রা আর অজয়ের মনে হতো কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারল, এটা ঠিক হওয়ার নয়। এই প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে।

একদিন অনিমা মেয়ের জন্য বিট-গাজরের জুস করে সকাল সকাল মেয়ের সামনে রাখলেন। চিত্রা এটা খেয়ে নে। এটা খুব উপকারী।

সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দাদেবী এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, বউমা, ওসব জুস-টুস খেয়ে কিছু হবে না। সকালবেলায় বেদানা, আপেল এগুলো চিবিয়ে খাও। এতে ফাইবারও যেমন আছে তেমনি শরীরও এর থেকে শক্তি পাবে। এছাড়া রক্ত বাড়াতেও সাহায্য করবে।

দুজনের কাণ্ড দেখে সুচিত্রা হতচকিত হয়ে গেল। দুজনের হাত থেকেই জিনিসগুলো নিয়ে পাশে টেবিলে নামিয়ে রাখল। দুজনের উদ্দেশ্যেই বলল, ঠিক আছে এগুলো সবকটাই আমার খুব পছন্দের। জুস, ফল সব আমি খেয়ে নেব কিন্তু একটু পরে। আমার একটু শুতে ইচ্ছে করছে, তোমরা দুজন যাও না, বাইরে থেকে একটু হেঁটে এসো।

ওদের বাইরে পাঠিয়ে সুচিত্রা লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অজয়কে ডাকল। পাশের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অজয় বলল, এ তো মহা মুশকিল হল চিত্রা। সকাল থেকে দুজনে মিলে তোমার পিছনে পড়ে যায়। এদিকে রাত বারোটার আগে ঘর ছেড়ে যায়ও না। আমাদের নিজেদের পার্সোনাল টাইম বলে কিছু আর রইল না।

পুরো আমার মনের কথা বলেছ অজয়। যে-কোনও ছোটো ছোটো ব্যাপার নিয়ে এদের তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে। আমার মা লেকচারার বলে মনে করেন ওনার নলেজ সবথেকে বেশি। আর এদিকে তোমার মায়ের ধারণা হল তোমাকে যেহেতু ভালো ভাবে মানুষ করেছেন, তাই ওনার সব পরামর্শ শুনতে আমরা বাধ্য।

সত্যি চিত্রা, তোমার সঙ্গে দুটো ভালোবাসার কথা বলব সে উপায় পর্যন্ত আমাদের নেই। বুঝতে পারছি না নিজেকে সেরা প্রতিপন্ন করার চক্করে এদের ঠান্ডাযুদ্ধে আর কতদিন আমাদের মানসিক শান্তি ভঙ্গ হবে?

মাঝেমধ্যে দুই বেয়ানের মধ্যে তর্কের বিষয় হয়ে উঠত সুচিত্রার ভবিষ্যৎ শিশু। ছেলে হবে না মেয়ে তাই নিয়ে দুজনের অমত সুচিত্রা এবং অজয়কে তিষ্ঠতে পর্যন্ত দিত না। সারাটা দিন হয় সুচিত্রা নয়তো অজয়কে ওদের দুজনের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হতো। বেচারা নিজেদের মধ্যে অবসর যাপন করার সময় পর্যন্ত পেত না ওরা।

একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে অজয় সুচিত্রাকে বলল, চিত্রা এবার আমাদের কিছু ভাবতে হবে। এটা একটা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন করেই হোক এর একটা সমাধান বার করতেই হবে।

একটা কৌশল করলে কেমন হয়? আমি বলছি কী করতে হবে। বলে অজয়ের কানে কানে সুচিত্রা কিছু বলতেই, অজয়ের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।

পরের দিন সকাল সকাল জলখাবারের টেবিলে সকলে বসে কথা হচ্ছে, তার মাঝেই অনিমাদেবীর মোবাইলটা বেজে ওঠে। সুচিত্রা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালে অনিমা ইশারায় জানান, সুচিত্রার বাবা ফোন করেছেন।

হ্যালো, এত সকালে ফোন করেছ? সব ঠিক আছে তো? অনিমাদেবীকে চিন্তিত দেখায়।

না, তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল। সুচিত্রার বাবার গলা ভেসে আসে।

এরই মধ্যে এমন কী হল যে, আমার কথা এত মনে পড়ছে? এই তো ক’দিন হল এসেছি। কপট রাগত স্বরে অনিমা স্বামীকে বলেন।

এই তো নয় ম্যাডাম, দু’মাস কেটে গেছে সে খেয়াল আছে? অনিমা, গত রোববার থেকে আমার শরীরটা খুব খারাপ।

সে কী! কী হয়েছে? আগে ফোন করোনি কেন? অনিমা চিন্তিত হয়ে ওঠেন।

হঠাৎ ব্লাডপ্রেশার হাই হয়ে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। ডান পায়ে হাঁটুতে খুব লেগেছে। হাঁটাচলা করতে পারছি না। বাড়িতে ছেলে, বউমা আছে ঠিকই কিন্তু বউমাকে দিয়ে তো সব কাজ করানো যায় না। ছেলে একটা লাঠি কিনে এনে দিয়েছে কিন্তু তোমার কাঁধের ভর আমাকে সাহস জোগাতে পারবে। আমি ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙে পড়ছি।

এত কিছু হয়ে গেছে তোমরা আমাকে কিছু জানাওনি? সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দিলে আমি তখনই চলে আসতাম। চোখে জল চলে আসে অনিমাদেবীর।

ঠিক আছে অনিমা। আমি অজয়কে তোমার টিকিট কাটতে বলে দিয়েছি। তুমি শুধু এখানে চলে এসো। তাহলেই আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব।

চিন্তা কোরো না, কালকেই আমি রওনা দিচ্ছি। আমি তো চিত্রার জন্যই এখানে আটকে ছিলাম, চিত্রার দিকে তাকিয়ে অনিমাদেবী বললেন।

চিত্রার শাশুড়িমা তো আছেন ওখানে। কিছুদিন উনিই দেখাশোনা করুন ওদের বউমার। আর তুমি আমার দেখাশোনা করো। বলে কৌতুকের হাসি খেলে যায় সুচিত্রার বাবার ঠোঁটে।

স্বামীর কথা শুনে অনিমাদেবী হেসে ফেলেন, তুমি আর বদলালে না। আচ্ছা আমি আসছি।

অজয় টিকিট সেদিনই কেটে নিয়ে এল। পরের দিন অনিমাদেবী মেয়েকে নানা পরামর্শ দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। সুচিত্রা আর অজয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

সুচিত্রার মা চলে যাওয়াতে বাড়িতেও শান্তি ফিরে এল। শাশুড়ি যতটা প্রয়োজন ততটাই মাথা গলাতেন। অজয়রাও নিজেদের জন্য সময় বার করে একসঙ্গে কাটাতে লাগল।

একমাস এভাবেই কেটে গেল। সুচিত্রার তখন আট মাস চলছে। ধীরে ধীরে কোনওরকম পরিশ্রম করা মুশকিল হয়ে উঠতে লাগল সুচিত্রার পক্ষে। রীণা বাড়ির সব কাজই করে দেয়। সুনন্দাদেবীর কাজ হল, খালি বউমার খেয়াল রাখা।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। একদিন অনিমাদেবী মেয়েকে ফোন করে জানালেন, চিত্রা এখন তোর বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি দু’তিন দিনে তোর কাছে আসছি। এই সময় তোর পাশে থাকাটা খুব দরকার।

কিন্তু মা, আমি ভালো আছি। তোমার এভাবে তাড়াহুড়ো করে আসার কোনও দরকার নেই।

কে বলল, দরকার নেই। এটা তোর প্রথম প্রেগন্যান্সি, আমার তোর কাছে থাকাটা খুব দরকার। তোর শাশুড়ি যে কতটা করছেন আমি খুব বুঝতে পারছি। তোকে আর তোর ভাইকে আমি জন্ম দিয়েছি। আমি জানি এসময় মেয়েরা তাদের মা-কে পাশে চায়। নে, এখন ফোন রাখ। জিনিসপত্র গোছাতে হবে যাওয়ার জন্য।

ফোন রেখে সুচিত্রা শোওয়ার ঘরে এসে আশঙ্কিত গলায় বলল, এবার কী হবে অজয়? আবার সেই মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে!

কী হয়েছে সেটা তো বলো। অজয় সুচিত্রার ঘাবড়ে যাওয়ার কারণটা জানতে চায়।

মা আবার এখানে আসছে। বাবা পায়ের চোট লাগার অভিনয় আর কতদিনই বা চালাতে পারে। এক মাসের মধ্যেই আমাদের সব কৌশল ভেস্তে গেল। সুচিত্রাকে খুবই হতাশ লাগছিল।

সান্ত্বনা দেওয়ার স্বরে অজয় বলল, কোনও কিছুই বৃথা হয় না চিত্রা। দ্যাখো ওই কৌশলই এবার আমাকে আমার মায়ের উপরে প্রয়োগ করতে হবে। তুমি বিশ্রাম করো, আমি কিছু একটা ভাবছি।

 

পরের দিন অজয় নিজের মায়ের ঘরে ঢুকে মা-কে বলল, মা তোমার মনে আছে গতবছর দেরাদুনে আয়োজিত টপ বিজনেস উইমেন সামিটে তোমার যাওয়ার কথা ছিল। তুমি ওখানে ওয়ার্কশপ এবং সেমিনারে অংশ নিতে খুব আগ্রহী ছিলে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরোরা আন্টির শরীর খারাপ হয়ে পড়াতে তোমরা দু’জনে যেতে পারোনি।

হ্যাঁ, মনে আছে। সিমির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেবার। ওকে ছেড়ে আমার একা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হয়েছিল।

তাই জন্য বলছি, এবারে অরোরা আন্টি ফুল ফর্মে রয়েছেন। উনি রিজার্ভেশন করাতে যাচ্ছেন। তুমি বলো তোমার কী প্ল্যান?

না রে অজয়, এবার আমি যেতে পারব না। আমার নাতি আসতে চলেছে। পরের বছর বরং প্ল্যান করব। নিঃশ্বাস ছাড়েন সুনন্দদেবী।

কিন্তু মা, আন্টি বলছিলেন পরের বছর উনি ইংল্যান্ডে যাবেন ছেলের কাছে। ওই সময় থাকবেন না। সুতরাং তোমার এটাই সুযোগ। আর নাতির চিন্তা কেন করছ? তোমার অনুপস্থিতিতে চিত্রার মা ওর দেখাশোনা করে নেবেন। দু’তিনদিনের মধ্যেই উনি চলে আসবেন।

কিন্তু অজয়…।

কোনও কিন্তু নয় মা। বেশি চিন্তা কোরো না শুধু প্ল্যানিং-এ লেগে পড়ো। দ্বিতীয়বার এই সুযোগ আর পাবে না। বেশ জোরের সঙ্গেই বলে অজয়।

তাহলে সিমিকে বলে দে আমারও রিজার্ভেশন যেন করে, বলে নিজের জিনিসপত্র এক জায়গায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুনন্দা।

অজয় আর সুচিত্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। যতদিনে অজয়ের মা ফিরবেন, ততদিনে সুচিত্রার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যাবে। সুতরাং সুচিত্রাকে আর দুই মায়ের মধ্যে পড়ে বলির পাঁঠা হতে হবে না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...