জীবনে একবারও অ্যাসিডিটি-র সমস্যায় পড়েননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেউ কেউ অকেশনালি এই সমস্যায় পড়লেও, বেশি সংখ্যক মানুষ অ্যাসিডিটি-র সমস্যায় লাগাতার ভোগেন। আবার এমন অনেকেই আছেন, যাদের নিয়মিত এই রোগভোগ করতে দেখা যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কমবেশি অ্যাসিডিটি-র সমস্যায় ভুক্তভোগী। তাই বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা বাজারে এনেছে অ্যাসিডিটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার নানারকম ওষুধ এবং তা ওষুধের দোকানগুলিতে বিক্রিও হচ্ছে মুড়িমুড়কির মতো।

যারা অতিমারির সঙ্গে যুদ্ধ করে সুস্থ হয়েছেন, তাদের শারীরিক দুর্বলতা কাটতে যেমন দেরি হতে পারে, তেমনই দীর্ঘ সময় লাগতে পারে পুনরায় রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুত করতে।

বেশিরভাগ মানুষই অ্যাসিডিটিকে কোনও সমস্যা মনে করেন না। তাই উৎসব-অনুষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত খাবার খাওয়ার পর অ্যান্টাসিড কিংবা ঠান্ডা পানীয় (ফ্রিজি ড্রিংক) খেয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। কিন্তু, অ্যাসিডিটি-র বিষয়টি এখন আর মোটেই হালকা ভাবে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ, নতুন চিকিৎসামূলক সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা নিয়মিত অতিরিক্ত তেলমশলা-যুক্ত খাবার খান, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই গুরুতর অ্যাসিডিটি-র সমস্যায় ভোগেন। আর দীর্ঘদিন এই সমস্যায় ভুগলে, এর থেকে আলসার, এমনকী ক্যানসার-এ আক্রান্ত হওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়।

লক্ষণ : কোনও কিছু খাওয়ার পর হঠাৎ গলা-বুক জ্বালা করতে থাকে এবং তখন মনে হয় যেন শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আর ওই জ্বালা যেন বুক থেকে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে এমনই অনুভতি হয়।

কারণ : আমাদের স্টমাক অর্থাৎ পাকস্থলিতে একধরনের পাচক রস উৎপন্ন হয়, যা খাবার হজম করতে সাহায্য করে। কিন্তু নানা কারণে পাকস্থলি স্বাভাবিক হজমশক্তির ক্ষমতা হারায়। এই কারণগুলির মধ্যে রয়েছে প্রযোজনের অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, দীর্ঘসময় অভুক্ত থাকার পর হঠাৎ প্রচুর পরিমাণে তেলমশলা-যুক্ত খাবার খাওয়া প্রভৃতি। শুধু তাই নয়, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কখন কোন খাবার খাওয়া উচিত আর কোনটা উচিত নয়, তা না জেনে ভুল খাবার খাওয়ার ফলেও অ্যাসিডিটি-র সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া, একটানা অনেকদিন সঠিক পদ্ধতিতে রান্না না-হওয়া খাবার কিংবা হাই প্রোটিন-যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলেও স্টমাক-এ বার্নিং সেনসেশন শুরু হতে পারে।

চিকিৎসা : অ্যাসিডিটি-তে আক্রান্ত হয়েছেন বুঝলে, স্টমাক থেকে অতিরিক্ত অ্যাসিড দূর করার জন্য অ্যান্টাসিড-এর একটা ডোজ নিতে পারেন। তবে, জ্বালাযন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এটা সাময়িক চিকিৎসার উপায় হতে পারে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা হতে পারে না। কারণ, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিগুলি সস্তার যে-অ্যান্টাসিড বাজারে বিক্রি করে, তা ঘনঘন কিংবা নিয়মিত খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই জ্বালাযন্ত্রণা থেকে তৎক্ষণাৎ আরাম পাওয়ার জন্য বাজারি অ্যান্টাসিড একটা-আধটা খেলেও, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করা উচিত।

কারণ, চিকিৎসক প্রথমে অ্যাসিড ব্লকার ডোজ দিয়ে পরে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। নয় থেকে বারো ঘণ্টার ব্যবধানে এই অ্যাসিড ব্লকার-এর ডোজ নিতে হয়। কিন্তু যাদের ক্রনিক অ্যাসিডিটি-র সমস্যা থাকে, তাদের আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে যাবতীয় মেডিকেল এগ্জামিনেশন-এর পরই সঠিক চিকিৎসা শুরু করা উচিত।

প্রতিরোধ : ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। অতএব, অ্যাসিডিটি-র সমস্যা যাতে শুরু না হয়, তার জন্য আগে থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান। প্রথমে অ্যাভয়েড করুন স্পাইসি এবং ফ্রায়েড ফুড। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খাবেন না। সময়মতো এবং উপযুক্ত পরিমাণ খাবার খান। ভাত, ডাল, টাটকা শাকসবজি খান নিয়মিত। কাজের চাপ থাকলেও, দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকবেন না এবং দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার পর হঠাৎ গলা পর্যন্ত খাবার খাবেন না। যাদের কনস্টিপেশন-এর সমস্যা আছে, তাদের উচিত বেশি পরিমাণ ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া।

প্রতিদিন অন্তত চার লিটার জল পান করুন, এতে খাবার হজম হবে ভালো। আঙুর, আপেল, পেয়ারা, কমলালেবু এবং কলা রাখুন আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। ফাস্টফুড খাওয়া বন্ধ করুন পুরোপুরি। জেনে রাখুন হেলদি ডায়েটের কোনও বিকল্প নেই। তবে প্রসঙ্গত জেনে রাখুন, বাঁধাকপি এবং গাজর অবশ্যই খাবেন কিন্তু একসঙ্গে নয়। কারণ এই দুই উপকরণ একসঙ্গে পেটে গেলে অ্যাসিডিটি তৈরি হয়।

সপ্তাহে অন্তত তিনদিন দিনে দু’বার ভেজ স্যুপ খাবেন অবশ্যই। এতে স্টমাক পরিষ্কার থাকবে এবং হজমশক্তি বাড়বে। বন্ধ করতে হবে ধূমপান এবং মদ্যপান। আর যারা দীর্ঘদিন ধূমপান করেছেন, তারা অবশ্যই প্রতিদিন দুটো করে কলা খাবেন। কারণ, কলা আলসার প্রতিরোধক। অবশ্য শুধু খাওয়ায় সংযম আনলে হবে না কিংবা উপযুক্ত খাবার খেলেই হবে না। খাবার হজম করানোর জন্য পরিশ্রমও করতে হবে।

আর যাদের কাজকর্ম কম অর্থাৎ বেশি পরিশ্রম করতে হয় না, তারা অবশ্যই ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করবেন এবং প্রতিদিন কিছুটা হাঁটাচলা করবেন, বিশেষ করে রাতে খাওয়ার পর। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমেরও প্রয়োজন আছে। রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমোবেন।

উৎসব উপলক্ষ্যে বাড়তি সতর্কতা

আমাদের যা মনে রাখা দরকার তা হল, এই অতিমারির আবহে উৎসবের মরশুমে প্রচুর খাবার  উপভোগ করলে, অম্লতা এবং অন্যান্য হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অম্লতা একটি খুব সাধারণ ব্যাধি হলেও, ক্রণিক অ্যাসিডিটি বড়ো বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাছাড়া, উৎসবের মরশুমে বাইরে খাওয়া, তেল-মশলাযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, জাংক ফুড খাওয়া, অতিরিক্ত খাওয়া, ভুল সময়ে খাওয়া প্রভৃতির কারণে মাটি হতে পারে উৎসবের আনন্দ।

আমরা অনেক সময় অ্যাসিডিটির উপসর্গ হিসাবে দেখি যে, পেট ফাঁপা, ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব, বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা প্রভৃতি। এগুলি মূলত অ্যাসিডের অতিরিক্ত নিঃসরণ, অ্যাসিডের রিফ্লাক্স, সাধারণ বদহজম এবং অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে ঘটে।

অম্লতা পিত্তথলির পাথর এবং এর জটিলতার লক্ষণও হতে পারে। যেহেতু এই সময়কালে মানুষ বিশেষ করে বাঙালিরা আমিষজাতীয় খাদ্য বেশি গ্রহণ করে, তাই এটি কোষ্ঠকাঠিন্য এবং শক্ত মল সৃষ্টি করে যা রক্তপাতের ফলে পাইলস এবং ফিশার হতে পারে।

তৈলাক্ত এবং চর্বি-যুক্ত খাবারগুলি এমন রোগীদের গুরুতর ব্যথার কারণ হতে পারে, যাদের পিত্তথলিতে পাথর রয়েছে। পিত্তথলির পাথর এবং অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ হতে পারে যা আপনাকে চরম অসুস্থ করে তুলতে পারে।

অন্য গুরুতর সমস্যা যা খাবার গ্রহণের ফলে হতে পারে, তা হল অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা খাবার বা সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি এমন খাবার।

তাহলে কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখা যাবে?

যতদূর সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তাজা ভাবে প্রস্তুত এবং  স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে সংরক্ষিত খাবার খান এবং বিশুদ্ধ জল পান করুন পর্যাপ্ত পরিমাণে। মনে রাখবেন, নোংরা জল-ই কিন্তু সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ। প্রতিদিন অন্তত আট ঘন্টা ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিন। এড়িয়ে চলুন জাংক ফুড। যতদূর সম্ভব খাবারের সময় বজায় রাখুন নিয়মিত।

এমন খাবার এড়িয়ে চলুন, যা আপনি জানেন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যদি আপনি এই ধরনের খাবার গ্রহণ বন্ধ করেন, তাহলে অ্যাসিডিটি-র সমস্যা কমে যেতে পারে। উদাহরণস্বরপ যদি কেউ আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরে কোষ্ঠকাঠিন্যর শিকার হয়, তাহলে তা বর্জন করা উচিত। আর, অ্যাসিডিটিপ্রবণ ব্যক্তিদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টাসিড গ্রহণ করা। সেইসঙ্গে, খুব বেশি মিষ্টি খাওয়া-ও বন্ধ করা উচিত। কারণ, অতিরিক্ত মিষ্টি শুধু অ্যাসিডিটি-র সমস্যায় ফেলে না, সঙ্গে ওজনও বাড়িয়ে দেয়।

অতিমাত্রায় খাওয়া এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। যারা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেন প্রায়-ই, তাদের উচিত আগে থেকে চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং ওষুধ খাওয়া।

  • ডা. সঞ্জয় মণ্ডল, গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল সার্জন

(ল্যাপারোস্কোপি এবং জিআই অঙ্কোসার্জারি)

এএমআরআই হাসপাতাল, সল্টলেক স্পেশালিটি ক্লিনিক

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...