গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।
এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।
অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।
বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।
গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।
গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।
প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।
পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।
তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।
এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।
গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।
নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।
মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।
হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।
তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।
গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।
এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।
আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।
সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।
গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।
গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।
পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।
—বর্ধনদা কেমন আছেন?
গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।
—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।
গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।
মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!
গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।
—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?
—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।
গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।
—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!
এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।
—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।
সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।
গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।
গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?
সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।
—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!
—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।
গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।
—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।
—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।
সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।
—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।
—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?
—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।
গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।
ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।
সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।
গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।
দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।
বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।
গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।
লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।
রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।
পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।
আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –
মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।
মিতা একটা দামি ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।
শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।
সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।
গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!
ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।
গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।
কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!
তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।