‘বিয়ের পর ১০ বছর কেটে গেল, কিন্তু এখনও রান্নায় পরিমাণমতো মশলা দিতে শিখল না তোমার মা। আরও কতদিন যে এই অখাদ্য খাবার খেতে হবে জানি না!’ স্ত্রীর বিরুদ্ধে ছেলের কাছে দীনেশ এমন নালিশ করতেই ছেলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, কিন্তু যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই রেনু তো খেপে লাল! সঙ্গেসঙ্গেই দীনেশের বিরুদ্ধে তার পালটা অভিযোগ, ‘আমার প্রতি কোনও সহানুভূতিই নেই তোমার বাবার। আমার শরীর ভালো নেই জেনেও, বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বসে রইল, বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফিরে একটু সাহায্য করতে পারত না কি? আমি শুধু একাই খেটে মরছি, কী সুখ পেলাম জীবনে? আরে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তো জন্তু-জানোয়ারও জুটিয়ে নেয়।’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেয়ে নেহার দিকে তাকিয়ে দীনেশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করতেই, ছোট্ট নেহা গম্ভীর হয়ে গেল। বাবাকে নিয়ে নেহার যে গর্ববোধ ছিল এতদিন, মায়ের অভিযোগের পর তাতে যে একটু পলি পড়ল, তা মুহূর্তের মধ্যেই নেহার চোখেমুখে ফুটে উঠল।

অনেক পরিবারেই এমন ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে। ঝগড়া-অশান্তির সময় রাগের মাথায় স্বামী বা স্ত্রী কেউ একবারও ভাবেন না যে, এর কতটা কুপ্রভাব পড়বে বাচ্চাদের উপর! অথচ বাচ্চারা ‘পারফেক্ট পেরেন্টস’ হিসাবে দেখতে চায় বাবা-মা-কে।

ঝগড়ার কুপ্রভাব

দিনের পর দিন বাবা-মায়ের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝগড়া Relationship দেখতে দেখতে বাচ্চাদের মন খারাপ হয়। ওরা যত বড়ো হতে থাকে, ততই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ওদের মনে হতে থাকে, ওরা যেন ক্রমশ স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ওদের বদ্ধমূল ধারণা হয়, বাবা অথবা মা কেউই ভালো নয়। এতে ওদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। জেদি স্বভাবের হয়ে যায়। শৈশবের সুকুমার বৃত্তিগুলি হারিয়ে যায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নেশা করা বা কুপথে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ অবশ্যই পারিবারিক অশান্তি। বাবা-মায়ের দৈনন্দিন ঝগড়া-ঝামেলার ফলে বাড়িতে যে-অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে ছেলেমেয়েরা। আর তাই ওরা নিজেদের অজান্তেই ভুল পথে পা বাড়ায়। মা-বাবারা নিজেদের মান-অভিমান কিংবা ঝুটঝামেলায় এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব খবর প্রায় রাখেনই না। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাইহোক না কেন, বাচ্চাদের প্রতি বাবা-মায়ের এই অবহেলার জন্য পারিবারিক ক্ষতি তো হয়ই, পরোক্ষভাবে সমাজেরও ক্ষতি হয়। অনেকসময় ছেলেমেয়েরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং জড়িয়ে পড়ে অসামাজিক কাজে।

ভুলের মাশুল

ছেলেমেয়ের সামনে প্রতিদিন ঝগড়া করার মাশুল একসময় দিতেই হবে বাবা-মাকে। কারণ, ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন বাবা-মায়ের বিশ্রী ঝগড়া দেখতে দেখতে ভাবতেই পারে, ‘বিয়ে করা মানেই বোধহয় পরস্পরের মধ্যে শুধু ঝগড়া আর ঝামেলা! এরথেকে বোধহয় বিয়ে না করাই মঙ্গলজনক।’ যে সব ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়েছে, তাদের সিংহভাগেরই এমন ধারণা হতে পারে এবং বাস্তবে হয়ও। ওরা যখন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন মা-বাবা রাজি করাতে চাইলে অপমানিত হন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে। ‘বিয়ে করে তোমরা কী সুখ পেয়েছ?’ এই ধরনের প্রশ্ন করে বসে ছেলেমেয়েরা এবং এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেন না মা-বাবারা। আর সত্যি বলতে কী, বাবা, মা ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে শুনিয়ে যদি বিয়ে দেনও, বিবাহপরবর্তী সময়ে ছেলেমেয়েরা একে অন্যকে ঠিকমতো সম্মান করতে পারে না। কারণ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ভালো কিছুর তুলনায় খারাপ দিকগুলিই আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণ করে আগে।

সমাধানের উপায়

মনে রাখতে হবে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে যেন বাচ্চাদের কোনও ক্ষতি না হয়। অনেক ধৈর্য, সহানুভূতি, ত্যাগ এবং সুক্ষ্ম বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে শান্ত মাথায় সিদ্ধান্ত নিলে, তবেই সংসারে সুখশান্তি আসে। তাছাড়া, পুরুষ বা মহিলা উভয়ের একশোভাগ মতের মিল না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ এক একজন এক একরকম পরিবেশে বড়ো হয়েছেন। প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্বতা থাকে। অতএব বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সুখেশান্তিতে বসবাস করতে গেলে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপ আলোচনা জরুরি। অন্যকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষ আছে কিনা তা আত্মবিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সেইসঙ্গে, জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী যদি কোনও দোষ কিংবা অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তা তাকে শান্ত ও সহজভাবে একান্তে বোঝাতে হবে। আর ত্রুটি শুধরে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময়ও দিতে হবে অন্যকে। এ প্রসঙ্গে আরও যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল, অনেকে খুব দ্রুত মাথাগরম করে ফেলেন বা রাগ করেন। এটা যে শুধু তার স্বভাবদোষ এমনটা না-ও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড প্রভৃতি নানা শারীরিক অসুস্থতার কারণেও মুহূর্তের মধ্যে রেগে যান অনেকে। তাই প্রয়োজনে মেডিকেল চেক-আপ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এছাড়া এমনকিছু সমস্যা থাকে, যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। কারণ স্বামী-স্ত্রীর ওই সমস্যা বাচ্চাদের সামনে এলে, খুব খারাপ ফল হতে পারে। অতএব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি মন কষাকষি Relationship বা রাগ অভিমান হয়ও, তা যেন ছেলেমেয়েরা বুঝতে না পারে। ওদের সামনে সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন। কারণ ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে মানুষ করা এবং ভবিষ্যৎ গড়ার দায়দায়িত্ব পুরোটাই যে বাবা-মায়ের উপর বর্তায়।

 

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...