ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…
শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে প্রিয়া।
‘হ্যালো।’
হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে ওঠে প্রিয়ার ছোটোপিসি সুশীলার গলা।
‘পিসি! এত রাতে ফোন করছ, কিছু হয়েছে নাকি?’
‘হয়েছে তো বটেই। কিন্তু তোকে যে কীভাবে বলি। শুনলেই তুই তো আবার রাগারাগি করবি। আমার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। ব্যাপারটা কীভাবে নিবি কে জানে?’
‘দ্যাখো পিসি হেঁয়ালি ছাড়ো, পরিষ্কার করে বলো তো কী হয়েছে?’
বেশ ত্রস্তকণ্ঠেই সুশীলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া, একটু আগেই বড়দি ফোন করে বলল, দাদা নাকি আবার
বিয়ে করেছে।’
‘কী যা তা বলছ… মাথার ঠিক আছে তো তোমার?’
‘যা তা বলছি না রে। দিদিই নাকি কোনও এক ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে দাদার বিয়েটা দিয়েছে।’
এত রাতে ফোনের আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল প্রিয়ার। ভয় পেয়েছিল কোনও খারাপ সংবাদ নয়তো! তার ভাবনাটাই সত্যি হল, কোনও মৃত্যুসংবাদ না পেলেও এই বয়সে তার বাবার বিয়েটা তার কাছে মৃত্যুসংবাদের থেকে কম শকিং নয়। পিসির কাছ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই হকচকিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছিল প্রিয়া। এ তার কাছে এক বিশাল লজ্জার ঘটনা। শাশুড়ি, বড়ো-জা, ননদ এমনকী স্বামী নীলাদ্রিকেই বা কী করে মুখ দেখাবে। তাদের সকলের কাছে তো হাসির পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে সে। একী করল বাবা। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না প্রিয়া, অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছিল।
প্রিয়ার বিয়ের সময়তেও তার বড়োপিসির এহেন কথার জন্য বেশ গোল বেধে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রিয়া রেগেমেগে পিসিকে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছিল। আজ এতদিন পরে প্রিয়া হাড়েহাড়়ে টের পাচ্ছে ওই মহিলা সেদিন সেই মুহূর্তের জন্য চুপ করলেও মনে মনে বদ্ধপরিকর ছিল তার একাকী, নিঃসঙ্গ দাদার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে পিসিকে দুষতে থাকে প্রিয়া। ‘পিসিকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু বাবা…! বাবা একবারও তার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এই ঘটনা তার বিবাহিত মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? সবাই বলত বাবা নাকি মেয়ে অন্ত প্রাণ। তাহলে বাবা এমন অবিবেচক হল কেন? ভারি অভিমান হল প্রিয়ার।
সংসার বলতে তো ছিল চারটে প্রাণী। প্রিয়া, প্রিয়ার বাবা নরেনবাবু, মা মোহিনীদেবী এবং অন্ধ, বিকলাঙ্গ ভাই হেমেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে এমন হওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মোহিনীদেবীর ভালোবাসা সংসারে যেন এক আশ্চর্য সুখশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসারে হঠাৎই একদিন বাধ সেধে বসে এক মারণ ব্যাধি। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন মোহিনীদেবী। ব্যস, দু’বছরের মধ্যেই সব শেষ। তখন প্রিয়া তেরো আর হেমেন বছর নয়েকের। তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। সময় তার নিয়মেই বয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাবা-মেয়ে মিলে সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছে। পাশাপাশি প্রিয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। বছর তিনেক হল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়েও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি মোহিনীদেবীর প্রতি সকলের ভালোবাসা।
তার নিজের বিয়ের পরেও কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। মাস আষ্টেকের একটি মেয়েও আছে। সবই তো ঠিক চলছিল। ভাইকেও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মিনতিদি বেশ যত্ন নিয়েই দেখাশোনা করছিল। তাহলে আজ কী এমন ঘটে গেল যে, এই বয়সে বাবাকে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হল? এই কথাগুলি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল প্রিয়াকে।
অনেকক্ষণ প্রিয়া আসছে না দেখে ঘর থেকে নীলাদ্রি ডাকতে থাকে প্রিয়াকে। নীলাদ্রির ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পায় প্রিয়া। কোনওরকমে চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ আসছি। এক্ষুনি আসছি।’
প্রিয়াকে দেখেই চমকে ওঠে নীলাদ্রি। ‘কী হল এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায়, চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন? কেঁদেছ নাকি? কার ফোন এসেছিল?
নীলাদ্রির প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারে না নীলাদ্রি। খানিকবাদে প্রিয়া নিজেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘জানো, বাবা আবার বিয়ে করেছে!’
অবিন্যস্ত, অগোছালো, বেদনাতুর প্রিয়াকে দেখেই নীলাদ্রি বুঝে গিয়েছিল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সুতরাং বৃষ্টি তো নামারই ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পরিস্থিতি সামলাতে ইয়ার্কির ছলে নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘সেকি বাবা বিয়ে করেছেন? এই বয়েসে? তা আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন না কেন?’
রেগেমেগে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘সবটাতে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। ভেবে দেখেছ এরপর লোকের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’
পরিস্থিতি হালকা করতে হাসতে হাসতে নীলাদ্রি বলে, ‘না দ্যাখো, সাদা চুলে টোপর পরে বাবাকে কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগাটা কি অন্যায় বলো? নাকি বাবা, বিয়ের আগে ডাই করেছিলেন কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না, জানলে না হয় একটু ফেসিয়াল, টেসিয়াল…’
নীলাদ্রির কথা শোনামাত্রই আরও জোরে কেঁদে ওঠে প্রিয়া।
‘আচ্ছা, আচ্ছা, সরি, বাবা আর ইয়ার্কি করব না, কিন্তু দ্যাখো ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে তখন মেনে নেওয়াটাই কি…’
নীলাদ্রির কথার ইঙ্গিত বুঝেই একপ্রকার গর্জে ওঠে প্রিয়া। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ এই বলে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।
ভাবগতিক খারাপ দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রিয়ার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায় নীলাদ্রি। নিজেও তার পাশে বসে তার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তুমি এখন কী চাইছ?’
নীলাদ্রির এই স্নেহস্নিগ্ধ আচরণে প্রিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। একটু শান্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বলো বাবা এটা কী করল? একবারও আমার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এসব জানলে শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে আমি কতটা হাস্যকর হয়ে উঠব। শুধু তাই নয় বাবা যে দেখাত মার মৃত্যুর পরেও বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, বাবার পৃথিবী নাকি মায়ের স্মৃতি জুড়েই, তাহলে সবই লোক দেখানো, মিথ্যে!’
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, ‘তুমি তো জানো আমি ওদের কতটা ভালোবাসি। আমার বিয়ের পর আমি কতটা চিন্তায় থাকতাম। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব বাবাকে একা হাতে সামলাতে হতো। প্রথমে বাবাকে হেল্প করার মতো কেউ ছিল না। ভাইয়ের পক্ষে তো নিজেরটাই নিজের সামলানো সম্ভব নয়। কাজেই সবসময় ওদের জন্য চিন্তা হতো। তারপর পাশের বাড়ির রমামাসি ওদের গ্রাম থেকে মিনতিদিকে এনেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকে তো বাবাকে আর সংসারের দিকে তাকাতে হয়নি। তাহলে, আজ কেন এই ডিসিশন?’
কথার মধ্যেই নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘প্লিজ আর কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। একটু জল খাবে?’
একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করে প্রিয়া। ‘রোজকার মতো কালকেও দু’তিনবার ফোন করেছি বাবাকে। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, বাবা এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে চলেছে। শুধু বলেছিল পিসির সঙ্গে নাকি কী দরকার আছে তাই পিসির বাড়ি যাবে। বাবার মনে এই ছিল!’
কথা বলতে বলতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যায় নীলাদ্রির। রাত আড়াইটে বেজে গেছে দেখে নীলাদ্রি বলে, ‘প্রিয়া অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে মিষ্টুর ভ্যাকসিনের ডেট আছে। শুয়ে পড়ো প্লিজ। একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল না হয় যা হোক একটা…।’
মেয়ের কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রিয়া একটু স্থির হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। আমি জানব মার সঙ্গে সঙ্গে বাবাও এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’
কথাগুলি শুনে নীলাদ্রি বলে, ‘ছিঃ প্রিয়া, উনি না তোমার বাবা। আজ না হয় একটা তোমার অপছন্দের কাজ করেছেন, কিন্তু এতদিন তো তাঁর কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করে এসেছেন। সম্পর্ক রাখবে না মনে হলে রেখো না, কিন্তু এরকম বাজে কথা বোলো না। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’
নীলাদ্রি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত প্রিয়া দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে এল। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির সকলে যে-যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর, ভাসুর অফিস যাবার জন্য আর শাশুড়ি, বড়ো-জা তাদের টিফিন, খেয়ে যাওয়ার রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অন্যান্য দিন প্রিয়াও তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগায়, কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার জন্য আজ তার হেঁশেল থেকে ছুটি। তাই সকালে প্রিয়াকে কারওরই মুখোমুখি হতে হল না।
তবে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও শ্বাশুড়ি স্নিগ্ধাদেবীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না প্রিয়া। ক্ষণিকের দেখাতেই তিনি প্রিয়ার চোখ-মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণবন্ত, ফুটফুটে ছোটোবউমাটির কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত শ্বাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও প্রিয়া আর তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক ব্যতিক্রমীই বলা যেতে পারে। স্নিগ্ধাদেবীর কোনও মেয়ে না থাকার কারণে তিনি তাঁর দুই বউকেই মেয়ের মতো ভালোবাসেন, তবে ছোটোবউমা প্রিয়াকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। ছটফটে, মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটির, শাশুড়ির মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। আর এই কারণেই বড়ো-জা সহেলির প্রচ্ছন্ন রাগও আছে। তবে সেটা মনে মনে। এমনিতে প্রিয়া আর বড়ো-জায়ের মধ্যে বেশ মিল, তবে মাঝেমধ্যে সংসারের নিয়মে যেমন ঘটি-বাটি ঠোকাঠুকি হয়, তেমনি আর কী। কিন্তু সেটা কোনওদিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছোয় না।
ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াকে চুপচাপ দেখে বড়ো-জা সহেলি তাকে ডেকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ আছিস যে!’
একটু চুপ থেকে প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কই কিছু হয়নি তো, মাথাটা একটু ধরেছে এই যা।’
দুপুরবেলাতেও খাবার টেবিলে একই জিনিস, যে প্রিয়া একমুহূর্ত বকবক না করে থাকতে পারে না, সেই প্রিয়া এত শান্ত, অথচ আজ আবার নীলাদ্রিও বাড়িতে। অফিস যায়নি। বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকে, খানিক বাদে বাদেই শাশুড়ির কাছে ছুটে যায় স্বামীর বিরূদ্ধে নালিশ করতে। আজ হঠাৎ করে তার স্বভাবে এতটা পরিবর্তন সত্যিই বাড়ির লোকের কাছে বিস্ময়কর বই-কি।
খাওয়া শেষ হতেই স্নিগ্ধাদেবী ছোটোছেলে আর বউমাকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বল তো তোদের কী হয়েছে রে? দ্যাখ সহেলির মতো আমাকে বোঝাতে যাস না। তোকে পেটে ধরেছি, আর ওকে পেটে না ধরলেও ওর শিরা-উপশিরা সব চিনি। কী হয়েছে বলে ফেল।’
ছলছলে চোখে মাথা হেঁট করে বসে থাকে প্রিয়া।
খানিক চুপ থেকে নীলাদ্রি বলে, ‘মা, ওর বাবা কাল হঠাৎ বিয়ে করে বসেছেন। তাই…।’
স্নিগ্ধাদেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বউমা, তোমার রাগ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একবার বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে দ্যাখো তো, বাড়িতে বিকলাঙ্গ ছেলে, যে নিজেরটুকু নিজে করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তার উপর অফিস, এই বয়সে একটা মানুষের পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? এতদিন তুমি ছিলে, দুজনে মিলে কোনওরকমে পরিস্থিতি সামলেছ, কিন্তু এখন তুমি নেই…।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই জল ভর্তি চোখে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘কিন্তু মিনতিদি তো আছে!’
‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু সে তো আদপে একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু নয়। তার উপর তুমিই তো বলতে, ইদানীং মিনতি মাঝেমাঝেই ছুটি নেয়। তাহলে সেই অবস্থাতে তিনি অফিস সামালাবেন না ঘর সামলাবেন। বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মুখের সামনে যে কেউ একগ্লাস জল ধরবে, সেরকমও কেউ নেই। তিনিও তো একটা মানুষ। চোখের সামনে অমন সমর্থ ছেলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই… এমন অবস্থায় তারও তো মনের দুটো কথা বলার লোক চাই। আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ওনার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত, যে তোমার বাবা-ভাইকে দেখাশোনা করার মতো একজন লোক এসেছে।’
শাশুড়ির কথায় খানিকটা হলেও মন হালকা হয় প্রিয়ার। গত দেড় দিনের ধকলে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়া।
এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। বহুবার চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন করে উঠতে পারেনি প্রিয়া, নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে।
হঠাৎ একদিন বিকালে বড়োপিসির আগমন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই বড়োপিসিকে দেখে বেশ অবাকই হল প্রিয়া। হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট আর ব্যাগ।
‘কিরে ভিতরে আসতে বলবি না?’
মনে মনে রাগ থাকলেও বলে, ‘হ্যাঁ এসো।’
ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়ে বলে, ‘নে এগুলো, তোর জন্যই এনেছি।’
‘আমার জন্য? কী এগুলো।’ প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় পিসির দিকে। মনে মনে ভাবে আর যাই হোক বড়োপিসি তার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবে না। ছোটোপিসি হলেও না হয়…। পিসির হঠাৎ এই দরদের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই, পিসি যেই ব্যাগটা থেকে নারকেলনাড়ু বার করেছিল সেই ব্যাগটার উপর নজর যায় প্রিয়ার। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ সে ঠিকই ধরেছে। এই ব্যাগটাতেই তো তার বাবা দোকান-বাজার করে। এটা থেকে প্রিয়া যেন তার বাবার গায়ের গন্ধ পেল। উৎসুক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তো বাবার ব্যাগ পিসি, তাহলে কি বাবাও এসেছে?’
‘হ্যাঁ এসেছে তো। কিন্তু তোর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে। এই সমস্ত জিনিস তো তোর নতুন মা-ই পাঠিয়েছে তোর জন্য। তোর বাবা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছে রে।’
মা-বাবা দুজনেই বাইরে অপেক্ষা করছিল।
পিসির কথা শুনে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে দরজার দিকে ছুটে যায় প্রিয়া।
মেয়েকে দেখামাত্রই মেয়ের দিকে অপরাধীর মতো এগিয়ে এসে নরেনবাবু বলেন, ‘আমায় ক্ষমা করে দিস মা, আমি তোর অপরাধী।’
এ ক’দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে বাবার চেহারাটা। প্রিয়ার মনে হয় বাবাও যেন এক দুর্নিবার মানসিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাগ নয়, এই মুহূর্তে ভারি মায়া হল প্রিয়ার। যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, তাতে যে-কোনও সময় কোনও ভারি অসুখে পড়তে পারে। কে দেখবে তখন বাবাকে। ভাবতে গিয়ে মনটা কেমন ভিজে যায়। বাবার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় প্রিয়া বলে, ‘না, বাবা এমন করে বোলো না। আমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছি, একবারও তোমাদের কথা ভাবিনি। ভাবিনি যে তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে।’
হঠাৎই প্রিয়া অনুভব করে পিঠে কারও একটা নরম হাতের স্পর্শ। ভারি মায়াময় সেই হাত। ঘুরে তাকাতেই এক বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধ চেহারার মহিলাকে দেখতে পায় প্রিয়া। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে মহিলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া আমি সোমলতা। আমি জানি, তোমার মায়ের জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না, ভরে দিতে পারব না তোমার মনে তাঁর অভাববোধ। কিন্তু দুটো অচেনা মানুষ, মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্ধুও কী হতে পারে না? হবে আমার বন্ধু?’
প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে যায়। কোনও কথা সরছে না মুখে। কিন্তু সোমলতার আন্তরিকতা তাকে কোথাও যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সমাজ আর সংস্কারে বাঁধা পড়া মনটা যেন শিকল ভেঙে বেরোতে চায়। বাবা ছোটো থেকেই তার আদর্শ ছিল, মানুষটা ব্যতিক্রমী বলে। আজ সেই বাবাকেই যেন আবার ফিরে পায় প্রিয়া।