বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা অতি গুরুত্বপূর্ণ এক পর্ব। একসময় পরিবারের মাসিমা-পিসিমারাই ঘটকালি করতেন। বাড়িতে বিবাহযোগ্যা কন্যা থাকলে তাকে বিয়ে দিয়ে পার করার চিন্তাটা সর্বাগ্রে তাদের মাথাতেই আসত। তারপর শুরু হতো চিরুনি তল্লাশি, কোন আত্মীয়-সম্বন্ধীর বাড়িতে চোখের আড়ালে রয়ে গেছে সেই ‘জামাতা রত্ন’। বহু অলস দুপুর এভাবে কেজো অপরাহ্নে পরিণত হতো। তাদেরই সক্রিয় সহযোগিতায় পাত্রস্থ হতো ‘আইবুড়ি’ কন্যা। আর ছিল ঘটকমশাইরা। এপাড়া-ওপাড়া বেড়িয়ে পাত্রের ঠিকুজিকুষ্টির খোঁজ ছিল যাদের নখদর্পণে। অনূঢ়া কন্যা পার করতে পারলেই জুটত মনহরা পারিতোষিক, সঙ্গে আরও কিছু অরক্ষণীয়াকে তরিয়ে দেওয়ার আগাম বায়না।

সেসব দিনকাল আর নেই। ঘটকঠাকুরের পরিবর্তে হয়ে উঠেছে সাইবার ম্যাট্রিমনি সাইট্স বা নিদেনপক্ষে কাগুজে বিজ্ঞাপন। আজকাল অবশ্য বহু আধুনিকাই আর বাবা-মা’র মনোনীত পাত্রকে এককথায় জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিতে চায় না। কেউ কেউ নিজের নির্বাচনের প্রতিই বেশি আস্থাশীল। কিন্তু সেই নির্বাচনও অনেকসময় ভুল হয়ে যায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে বিষয়টা। ঘটনাগুলি সত্য হলেও চরিত্রগুলির সামাজিক পরিচয়ের কথা মাথায় রেখে, নাম পরিবর্তন করা হল।

ইন্দ্রাণী ও পল্লব, এমবিএ পড়াকালীনই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে এবং দুজনে দুটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাক্-বৈবাহিক মেলামেশার সময়টাতেও পল্লব, ইন্দ্রাণীর আবেগকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। প্রায়ই নানা কাজের অজুহাতে দেখা করার প্ল্যান ভেস্তে দিত, কখনও একটিও প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যয় করত না ইন্দ্রাণীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু ইন্দ্রাণীর চোখে তখনও মোহ-অঞ্জন। তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সে অনড়। ফলাফলঃ বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই তার প্রাণান্তকর অবস্থা। পল্লবের ব্যবহার দিনকেদিন খারাপ হতেই থাকল। অবশেষে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে হল ইন্দ্রাণীকে।

বাবা-মায়ের বারণ সত্ত্বেও পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে ভিন্নধর্মের একটি ছেলেকে বিয়ে করে বসল তৃণা। ছেলেটি তাকে ধর্মান্তরিত করল তো বটেই, এমনকী বিয়ের পর, তার সেই আগের উদার মানসিকতাতেও ঘটল আমূল পরিবর্তন। ছেলেটি ও তার পরিবার তৃণাকে আপন করে তো নিলই না, উপরন্তু তার জন্মসূত্রে লাভ করা ধর্ম নিয়েও নানা তির্যক মন্তব্য করা শুরু করল।। বিবাহপূর্ব প্রণয়ের সময় তৃণা ছেলেটির জোরাজুরিতে দু-একবার সহবাসে লিপ্ত হয়েছিল, অথচ এখন সেই ঘটনার উল্লেখ করেই ছেলেটি (তার বর্তমান স্বামী) তাকে দুশ্চরিত্র আখ্যা দিতেও ছাড়ে না। এহেন ব্যবহারে তৃণার জীবন আজ বিষময় হয়ে উঠেছে। নিজের বাড়িতে ফেরত যাবার মুখ নেই তার, আর এভাবেও বাঁচা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ইন্টারনেটে চ্যাট করতে করতে সুলগ্নার সাইবার বন্ধুত্ব হয় সুমিতের সঙ্গে। পরে তা ক্রমশ গভীর প্রেমে রূপান্তরিত হয়। প্রতিদিন নানা সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করতে করতে একসময় সুলগ্না সুমিতকে তার জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু বিপত্তিটা বাধল প্রস্তাবটা সুমিত নাকচ করে দেওয়ায়। সুমিত পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে, সে এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিতে চায় না। এরপরও সুলগ্না বন্ধুত্ব রাখতে চাইলে ভালো– নাহলে মুক্তির পথ খোলা। প্রতারিত-অপমানিত সুলগ্না একেবারে ভেঙে পড়ল এই প্রত্যাখ্যানে। নির্বাচনে এত বড়ো ভুল সে প্রত্যাশা করেনি।

এই ঘটনাগুলোয় যতই বিভিন্নতা থাকুক, তা একটি জিনিসই স্পষ্ট করে যে, এরা প্রত্যেকেই ভুল জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে ফলভোগ করেছে। অর্থাৎ জীবনে ঠিক মানুষটিকে খুঁজে নেওয়াটাই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকেই অচেনা মানুষকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করবেন না পণ করে, ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচন করে অযথা খানিকটা সময় অপচয় করেন। কখনও কখনও এর জন্য ভারী মূল্যও চুকোতে হয়। সুতরাং প্রেমজ বিয়ে অর্থাৎ লভ ম্যারেজ যারা করছেন না, তারা মানসিক প্রস্তুতি রাখুন যে সব মানুষই খারাপ নন। সুতরাং অচেনা ব্যক্তিটিকে স্বামী হিসাবে বরণ করার পরও প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করা যায়। সমস্যাটা হল বহু মেয়েই ভবিষ্যৎ স্বামী নির্বাচনের বিষয়টিতে মগজের চেয়ে বেশি হৃদয়কে গুরুত্ব দিয়ে ভুল করেন। বয়সের ভুলে হঠকারি সিদ্ধান্তে জীবন নষ্ট করা মেয়েদের সংখ্যাটাও কম নয়।

বিএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী সোমলতা এমনই এক চূড়ান্ত ভুল করে বসেছিল। সে স্বপ্ন দেখত রুপোলি পর্দার নামি অভিনেত্রী হওয়ার। তার শিক্ষকের প্রেমে পড়ে সে বলিউডে পাড়ি দেয় সেই শিক্ষককেই স্বামীরূপে বরণ করে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য তার কোনও অনুতাপ ছিল না শুরুতে কিন্তু ক্রমাগত স্বামীর দ্বারা ‘সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়টেড’ হতে হতে তার ভুল ভাঙে। ছবিতে সুযোগ পাওয়ানোর নাম করে তার স্বামী তাকে বহু অচেনা লোকের শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য করে। তার স্বামী নামক লোকটি যে তাকেই শেষ পর্যন্ত টাকা উপার্জনের হাতিয়ার করবে, তা ভাবতে পারেনি সোমলতা। প্রতিবাদ করায় তাকে মুম্বইয়ের ‘অন্ধগলি’তে বিক্রি হয়ে যেতে হয়। শেষে এক এনজিও’র সাহায্যে সে ফিরে আসতে পারে তার নিজের বাড়িতে।

বয়সের ভুলের আর-একটি দুঃখময় দৃষ্টান্ত সুস্মিতার ঘটনাটা। বয়সে প্রায় দ্বিগুন বস-এর প্রেমে পড়ে সুস্মিতা। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই, ডিভোর্সের মামলা চলছে ইত্যাদি ভুল বুঝিয়ে গোপনে সুস্মিতাকে বিবাহ করে লোকটি। প্রায় তিন বছর একসঙ্গে থাকার পর, অন্তঃসত্ত্বা সুস্মিতা হঠাৎই অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং কোনও ডিভোর্সের মামলাও এবাবদ লড়ছে না তার স্বামী। স্বাভাবিক কারণেই সুস্মিতার নিজের জীবন এবং পৃথিবীর আলো না-দেখা সন্তানটির জীবন কালিমাময় হতে চলেছে তা বুঝতে পারে সুস্মিতা। এই অবস্থায় পথ দেখানোর জন্য একটি ‘উইমেন ওয়েলফেয়ার’ সংগঠনের শরণাপন্ন হয়েছে সে।

বয়সে বড়ো কোনও লোকের প্রেমে পড়ার প্রবণতা যদিও নতুন নয়, তবু এর হার ক্রমাগত বাড়ছে। ইলেকট্রা কমপ্লেক্স-এর কারণেই হোক বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সদর্প প্রকাশ, বহু মেয়েই নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে পা দেয় এই অপ্রতিরোধ্য হাতছানিতে। কেউ কেউ মানুষটির প্রভাব, প্রতিপত্তি বা বিত্তের মায়াতেও যে সাড়া দিয়ে ফেলে, এমনটাও দেখা গেছে। ভুলের মাশুল দিতে প্রচুর অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে।

বয়সে প্রবীণ ব্যক্তিকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য যতই কেন-না ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ থাকুক, বস্তুত এই ধরনের সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদী হয় না। বার্ধক্যজনিত কারণে যৌনচাহিদার অসামঞ্জস্য, মেয়েটি বিধবা হওয়ার সম্ভাবনা প্রভৃতি তো থাকেই, আরও থাকে মানসিক বৈষম্যের বিষয়টি। এর ওপর আবার স্বামীটি যদি পূর্বের বিবাহ ভেঙে এসে থাকে তাহলেও কমবয়সি নবপরিণীতা নানা রকম কমপ্লেক্স-এর শিকার হয়। প্রৌঢ় মানুষটিও সহজেই ‘বোরড’ হয়ে যান নববধূর ছেলেমানুষিতে। অতএব এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবনাচিন্তা করা জরুরি।

জীবনসঙ্গী বাছতে হলে

– প্রথমেই মনের মিল, শখের মিল প্রভৃতি বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিন।

– ছেলেটি জীবনে প্রতিষ্ঠিত কিনা ভালোভাবে খোঁজখবর নিন, তার সামাজিক অবস্থান জেনে তবেই এগোন।

– পাত্রের সঙ্গে বয়সে একটা সামঞ্জস্য রাখুন।

– বিয়ের আগে কিছুদিন মেলামেশা করুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন সে আপনার ভালোলাগা, আবেগ প্রভৃতি সুকোমল বৃত্তিগুলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা।

– বোঝার চেষ্টা করুন ছেলেটির কথার খেলাপ করার প্রবণতা আছে কিনা।

– ছেলেটির মনের জোর সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ হোন। সে যেন পরজীবী শাখার মতো আপনার উপর নির্ভরশীল না হয়।

– ছেলেটির পরিবারের মানুষদের সঙ্গে আপনার পরিবারের আলাপ করিয়ে দিন, যাতে উভয়েই বুঝতেই পারে মিলমিশ হবে কিনা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...