আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। আকাশে-বাতাসে উৎসবের আমেজ। রাতের চোখজুড়ানো আলোর রোশনাইয়ের রেশ চোখেমুখে লেগে রয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোর স্কুলও ছুটি। আনন্দ করে দিনটা কাটানো যাবে। গেলও তাই। বিকেলে হঠাৎ ভাই ফোনে জানাল, এবার সে ভাইফোঁটায় আসতে পারবে না। অফিস থেকে নাকি ছুটি পায়নি। মুহুর্তেই মনটা কেমন যেন ভার হয়ে গেল। হুট করে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অতদূর যাওয়াও তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। গুম হয়েই বসেছিলাম। সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় সাহেবের বায়না মা ব্রেডরোল বানিয়ে দাও। অগত্যা সবকিছু ভুলে রান্নাঘরে ছুটলাম।
ঠিক সেই সময় তনুর আওয়াজ কানে ভেসে এল, ‘মা রামলাল জেঠু এসেছে।’ মনে হল ওনাকে বসতে বলে তনু কোথাও পালাল।
‘ওফ্, বোর করতে চলে এসেছে।’ কথাটা নিজেকে শুনিয়েই যেন বলল, এমন ভাব করে সাহেব দৌড়ে সোজা পড়ার ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ল।
উনি এতটাই ‘বোরিং’ যে বাচ্চারাও ওনার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। সন্দীপও অফিস থেকে ফেরেনি।
ব্রেডরোল বানাবার পুর তৈরি করছিলাম। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোব কী, উনিই রান্নাঘরে হাজির। এদিক-ওদিক দেখে জোরে একটা নিশ্বাস টেনে বললেন, ‘বাহ্। দারুণ গন্ধ। মনে হচ্ছে আজ স্পেশাল কিছু হচ্ছে ?’
‘হ্যাঁ, বাচ্চাদের আবদার আর কী!’
‘আজ তাহলে সন্ধের জলখাবারটা ভালোই জুটবে, কী বলো কাকলি। আমিও তো ওদের মতোই বাচ্চা নাকি।’ বলেই এমন ভাবে হাসতে শুরু করলেন যেন আমি ওনার খাস ইয়ার দোস্ত।
আর কোনও পথ না দেখে কড়া চাপিয়ে ব্রেডরোল বানাতে শুরু করলাম। ততক্ষণে উনি সাহেবের ঘরে পৌঁছে গেছেন। ‘আচ্ছা সাহেববাবা পড়াশোনা করছে। তাহলে তো ডিসটার্ব করা যাবে না’ বলে বাইরে বেরিয়ে সোফায় বসেই উচ্চস্বরে শ্যামা
সংগীত ধরলেন ‘শ্যামা মা কী আমার কালো রে, শ্যামা মা কী আমার কালো…’।
ওনার হাত থেকে বাঁচতে সাহেবের এই ধারালো অস্ত্র বরাবরের মতো এবারেও সফল। খাবারের প্লেট ওনার হাতে ধরিয়ে, নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম ওনার ‘জরুরি’ কথা শোনার জন্য। ওনার গ্রাম, খেতখামার, পঞ্চায়েত নিয়ে– সেই ঘ্যারঘ্যারে রেকর্ড আবার বাজতে শুরু করল। এই নিয়ে সাহেবও কম ঠাট্টাতামাশা করে না। কখনও কখনও বলেই বসে, ‘তা জেঠু সবকিছু যখন এতই মিস করো, তাহলে সেখানে গিয়েই থাকলে পারো। অনর্থক এখানে পড়ে আছো কেন?’
‘অপারগই বলতে পারো আমায়। খেতখামার, ঘরবাড়ি কিছুই তো আর নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম এখানে। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। বড়ো হওয়ার মনোবাসনা তো ছিলই, মাথাটা সাহায্য করল। ইঞ্জিনিয়র হয়ে গেলাম।’
মাথাটাও সাহায্য করল শুনে সাহেবের সে কী হাসি। একা বসে ওনার কথা শুনতে শুনতে সাহেবের টিপ্পনিগুলো মনে পড়ে গেল। অজান্তেই কখন ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠেছে নিজেও বুঝতে পারিনি। মনে হয়, রামলালবাবু তখন ওনার পিতার মৃত্যু নিয়ে কিছু বলছিলেন, যা এর আগে বহুবার শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুপ্রসঙ্গ চলাকালীন এমন অযাচিত হাসি তিনি বোধহয় মন থেকে মানতে পারেননি। হঠাৎ-ই ওনার থমথমে মুখ দেখে বুঝতে পেরে সংযত হলাম।
‘সন্দীপ তো এখনও এল না। ভাবছিলাম ওর সাথে বসে এককাপ চা খাব।’
বুঝলাম চা না খেয়ে উনি এক পা-ও নড়বেন না। কাজেই চুপচাপ চা বানিয়ে এনে দিলাম। এক-দেড় ঘন্টা বাদে যখন গেলেন তখন মাথাটা বেশ ধরে গেছে। সাহেবের ঘরে গিয়ে দেখলাম হাতটা গালে দিয়ে বসে কী যেন ভাবছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল কী ভাবছিস।’
দার্শনিকের মতো জবাব দিল, ‘জানো মা, জেঠুর বাড়িতে আসার একটা ভালো দিকও আছে।’ বলেই বইটা হাতে নিয়ে দেখিয়ে দিল, ‘দ্যাখো এই কঠিন চ্যাপ্টারটা মুখস্ত হয়ে গেল।’
মাথাটা এত ধরেছিল যে ওর কথায় কোনও প্রতিক্রিয়াও করতে পারলাম না। গিয়ে শুয়ে পড়লাম। খানিক পরে সন্দীপ ফিরতেই সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওর উপর। ‘কেমন লোকেদের সঙ্গে আত্মীয়তা তোমার? যাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সে যখন-তখন কথা নেই বার্তা নেই বাড়ি বয়ে চলে আসে।’
‘রামলালদা এসেছিল বুঝি?’ মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে সন্দীপ।
‘তাছাড়া আর কে! দেড় ঘন্টা ধরে বসে ছিল। ভব্যতা-টব্যতা কিছু জানে না। চা-জলখাবার খেল তবে গেল এখান থেকে।’
‘আর ক’টা দিনের-ই তো ব্যাপার কাকলি। তারপর তো ওর বউ-বাচ্চা চলে আসবে। তখন দেখবে যাওয়া-আসা এমনিই কমে যাবে। একা থাকে। যদি একটু চা-জলখাবার খায়, তাতে কী এমন ক্ষতি বলো তো!’
‘হ্যাঁ, তা তো বলবেই। নিজেকে সহ্য করতে হলে বুঝতে।’ গজগজ করতে করতে গ্যাস অন করলাম।
‘জেঠু চলে গেছে?’ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল তনু।
‘আমার তো ভয় হচ্ছিল ফিরেও যদি দেখি জেঠু আছে। তাহলে তো সেই একই গল্প আবার শোনাবে।’
এগারো বছরের ছোট্ট তনুও বুঝে গেছে একঘেয়ে জিনিসটা কী! ভোপাল থেকে বদলি হয়ে যখন নতুন এসেছিলেন, তখন সাহেব আর তনু ওনার কোল ঘেঁষে বসে পড়ত গল্প শোনার জন্য। আর এখন দেখলেই দৌড়োয়। ছেলের পড়াশোনার জন্য রামলালবাবুর স্ত্রী ভোপালেই থেকে গেছেন। পড়াশোনা শেষ হলে এবার ফিরবেন। ততদিন এই মহাশয়কে সহ্য করতে হবে।
আমাদের পড়শি মধুলিকারও জবাব নেই। যখনই আসবে খোঁচা ওকে দিতেই হবে। ‘কী কাকলি আজ রামলালবাবু আসেননি।’ ভাবটা এমন যেন উনি রোজ আসেন।
তারপর বলবে, ‘তুমিও পারো। এরকম একটা লোককে কী করে আশকারা দাও কে জানে। দেখলেই গাঁইয়া ভূত মনে হয়। মাথায় চপচপে তেল। টেরিকাটা সিঁথি। পোশাক-আশাকেরও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। সন্দীপদা যে কী করে ওনার বন্ধু হলেন…।’
একদিন সন্ধ্যাবেলা সিরিয়াল দেখতে বসেছি। দারুণ ক্লাইম্যাক্স। বাড়ির মুখরা বড়োবউ ঝগড়ার সময় শাশুড়িকে ছোটোলোক বাড়ির মেয়ে বলে বসেছে। সেই নিয়েই ড্রামা বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় কলিংবেল-এর আওয়াজ। একবার ভাবলাম, দূর সিনটা দেখে তারপরই যাব। পরমুহূর্তেই মনে হল, যদি সেরকম কেউ হয় তাহলে কিছু মনে করতে পারে। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। রাগে গা-টা জ্বলছিল। তার উপর ঘরে ঢুকেই লাটসাহেব বলে বসলেন, ‘কাকলি এক কাপ চা হবে নাকি?’
কোনওমতে রাগ সংবরণ করে বললাম, ‘চা যে শেষ হয়ে গেছে দাদা।’
‘চা শেষ হয়ে গেছে কী বলছ! কালই তো অফিস থেকে ফেরার পথে মোড়ের মাথার টি-জংশন থেকে আড়াইশো চা কিনল সন্দীপ। মোড়ের মাথাতেই দেখা হল ওর সঙ্গে। আমিও তো সঙ্গে গেলাম।’ বেশ আশ্চর্য হয়েই বলে গেলেন উনি।
ক্ষণিকের জন্য হকচকিয়ে গেলেও আগেই মনস্থির করেছিলাম আজ কোনও মতেই ওনাকে এন্টারটেইন করব না। বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখেছেন ঠিকই। চা কিনেছে বটে, তবে সে চা আর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। পথেই হোঁচট খেয়ে সব পড়ে গেছে।’
‘ওঃ তাই। সকালে তো দেখা হল, কই কিছু বলল না-তো সন্দীপ। কোথাও লাগে-টাগেনি তো?’ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন রামলালবাবু। উত্তেজিত হয়েই বললাম, ‘এতে আর বলার কী আছে। কিছু হলে তো জানতেনই।’
মাথাটা নাড়িয়ে বললেন, ‘তা বটে। ঠিক আছে কাকলি তাহলে আমি নিয়ে আসছি।’
প্রত্যুত্তরে বললাম, ‘না না, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আসলে আমারও একটু বেরোনোর আছে।’
এই ঘটনার পরে উনি যতবার এসেছেন, আমার থেকে এরকম ব্যবহারই পেয়েছেন। প্রথম প্রথম এজন্য আমারও খারাপ লাগত। পরে মনে হল, যাকে আমি পছন্দই করি না, তার সাথে সদ্ব্যবহার কীসের। তেল চপচপে মাথার, পান চিবোনো ওই লাল দাঁতের নির্লজ্জ হাসি, দেখলেই গা-টা রিরি করে উঠত। সম্ভবত উনিও বুঝতে পেরেছিলেন। আসা-যাওয়াও অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে সন্দীপ জোর করে ধরে নিয়ে আসত। চা-জলখাবার খেয়ে চলে যেতেন। এতে অবশ্য আমি ভীষণ আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
সেদিন স্নান সেরে জামাকাপড় ধুচ্ছি। কলিংবেলটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। সমানে চিৎকার করছি আসছি আসছি তৎসত্ত্বেও আগন্তুকের কানে ঢুকছে না।
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, রামলালবাবু। দরদর করে ঘামছেন। দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘সন্দীপ বাড়িতে নেই৷’ উনি ইশারা করে কিছু বলতে চাইছিলেন দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
‘কাকলি বাচ্চারা কোথায়?’
‘স্কুল ছাড়া কোথায় থাকবে এসময়ে?’
কোনও জবাব না দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চলো। সন্দীপের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’
শোনা মাত্র মাথাটা ঘুরে গেল। চারিদিকে কেবল অন্ধকার মনে হল। উনি কোনওমতে আমাকে ঘরে এনে বসালেন। এক গ্লাস জল দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, মারাত্মক কিছু হয়নি।’ জানি না কেন ওনার কথা ঠিক বিশ্বাস হল না। অতি বড়ো দুঃসংবাদ
দেওয়ার সময়ও,সান্ত্বনা দিতে লোকে এসব বলে। মনটা বড়ো কু-গাইতে থাকল।
কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। রামলালবাবুই তালা লাগালেন। আমার যেন সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের মতো কী যে করছি আমি নিজেই জানি না।
‘একটা বাচ্চা ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সন্দীপের স্কুটারের কাছে চলে এসেছিল। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়েই যত বিপত্তি। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ও-ই স্কুটার থেকে পড়ে গেল। সেইসময়ই পাশ দিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে ধাক্বা মারে। উঠে দাঁড়াতে পারছিল না।’ শুনে আমার গাল বেয়ে ঝরঝর করে জল নেমে আসছিল। মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছিল।
‘ওই অবস্থাতেই ১০-১৫ মিনিট পড়েছিল সন্দীপ। লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করেনি।। ভাগ্য ভালো, সেই সময় আমি ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। নয়তো…’
ওনার কথাও ঠিক করে কানে আসছিল না। শুধু উপরওয়ালার উদ্দেশ্যে একটা প্রার্থনাই করে চলেছি, ‘ভগবান সন্দীপ যেন ঠিক থাকে, সুস্থ থাকে।’
রামলালবাবু আবারও বলে উঠলেন, ‘কাকলী, সন্দীপের সামনে কিন্তু তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।’ বোঝালেন ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালের বেডে ওকে শুয়ে থাকতে দেখেই চোখ ফেটে জল চলে এল।
এমন সময় সন্দীপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নার্স জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিই কী ওনার স্ত্রী? ডাক্তারবাবু পেশেন্টের বাড়ির লোকদের খুঁজছিলেন।’
চোখের জল মুছতে মুছতে সম্মতি প্রকাশ করলাম, ‘হ্যাঁ।’
‘দেখুন ভয়ের কিছু নেই। তবে ওনার বাঁ-পায়ের কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। এখুনি অপারেশন করতে হবে।’
ডাক্তারের অভয়বাণী শুনে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। মনের মধ্যে ওঠা হাজারও আশঙ্কা থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। রামলালবাবুর হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধগুলো আনার জন্য বলে গেল নার্স।
খানিক পরেই ওর জ্ঞান ফিরে এল।
‘কাকলি।’
‘এই তো আমি। তোমার পাশেই আছি।’ সন্দীপের কাঁধে হাত রেখে বললাম।
তারপরেই ছটফট করতে লাগল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেয়ো না।’ বলেই ছুটে গেলাম নার্সের কাছে। উনি এসে যন্ত্রণার ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলেন। তার খানিক পরেই সন্দীপ ঘুমিয়ে পড়ল।
‘কাকলি, এই নাও ওষুধগুলো রাখো। আর হ্যাঁ এই ফলগুলোও। ডাক্তার বললে দিও। আমি দেখি অফিসে বলে ওর জন্য টাকাপয়সার কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
বাচ্চাদের কথা একদমই খেয়াল ছিল না। রামলালবাবু যাওয়ার বেশ খানিকক্ষণ পর মনে পড়ল। তাড়াহুড়োতে ওদের কথা মনেই হয়নি। এতক্ষণে তো দুজনেই স্কুল থেকে চলে এসেছে। ঘরে তালা দেখে কোথায় যাবে, কী করবে? ভাবতে পারছিলাম না। মনে পড়ে গেল মধুলিকার কথা। তাইতো ওকেও তো ফোন করে বাচ্চাদের রাখতে বলতে পারি। দেরি না করে নাম্বার ডায়াল করলাম। ফোনে সমস্ত কিছু জানালাম ওকে।
‘ওহ্ তাই। খুবই দুঃখের খবর। বেশি চোট আঘাত পায়নি তো?’
‘বাঁ-পা গুরুতর জখম হয়েছে অপারেশন করতে হবে।’
‘আহা-রে, আমাদের কোনও সাহায্য লাগবে না তো?’
ও ‘না’ এর উপর এমন জোর দিয়ে বলল যে, কান্না পেয়ে গেল।
‘যদি বাচ্চারা এলে একটু দেখতে,’ বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ওকে বলব, বাচ্চাদের একটা রাত ওর বাড়িতে রাখতে।
‘তুমি চিন্তা কোরো না, ওরা ফিরলেই আমি জানিয়ে দেব যে তোমরা মেডিকিওর হাসপাতালে আছো,’ বলেই ফোনটা রেখে দিল। আর কোনও কিছু বলার সুযোগই দিল না।
পাগলের মতো কেবিনের মধ্যেই ছটফট করতে শুরু করলাম। এ অবস্থায় সন্দীপকে একা ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এরা তো যখন-তখন ওষুধের জন্য প্রেসক্রিপশন ধরাচ্ছে। এরপর ওটি। কিন্তু বাচ্চারা! আবার পরমুহূর্তেই মনে হল, না ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, নিজেদের ঠিক সামলে নিতে পারবে। ঘরে তালা দেখে নিশ্চয়ই একবার পাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করবে। পরক্ষণেই মনে হল, আচ্ছা আচ্ছা লোক এ-রকম খবর শুনলে ঘাবড়ে যায়, সেখানে ওরা তো শিশু। ইশ্ এই বিপদের সময় যদি ভাইটা কাছে থাকত। অন্তত পাশে দাঁড়ানোর মতো…। কারওর একটা গলার অস্ফুট স্বরে ভাবনায় ভাটা পড়ল। পিছন ফিরে দেখি রামলালবাবু।
‘সাহেব আর তনুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। খাবারও বেড়ে দিয়ে এসেছি। সাহেববাবা আসার জন্য বায়না ধরেছিল। কোনওমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবে আসতে পারলাম।’
মনে পড়ে যাচ্ছিল, কথায় কথায় রামলালবাবুকে নিয়ে সাহেবের ব্যঙ্গ, ওনার চলনবলন সবকিছু নকল করে দেখানো, ওঁকে এড়িয়ে চলা। লজ্জায় মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম।
কৃতজ্ঞতাভরা স্বরে বললাম, ‘দাদা, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন, আপনি জানেন না। বাচ্চাদের কথা ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।’ বলেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
‘ছি ছি, এভাবে বোলো না। এ তো আমার কর্তব্য।’ বলেই আমার হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘টাকাটা রাখো। আপাতত যা পারলাম জোগাড় করেছি। অপারেশনটা তো হোক। পরে না হয় অফিসে একটা বন্দোবস্ত…।’
চোখ দুটো ভিজে গেল আমার। টাকাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস্ ডেস্ক-এ।
অপারেশন শেষে সন্দীপকে বেডে দেওয়ার পর রামলালবাবু আমায় বললেন, ‘এবার বাড়ি যাও। বাচ্চারা অনেকক্ষণ একা আছে। আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না, চিন্তা কোরো না। যাও।’
বাড়ি ফিরে দেখলাম তনু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর সাহেব গালে হাত দিয়ে বিছানার এককোণে বসে রয়েছে। চোখদুটো লাল। আমাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘বাবা কেমন আছে মা? বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?’
বললাম, ‘বোকা ছেলে, বাবা কেন ঠিক হবে না?’
‘দেখিসনি সাহাকাকুর যখন পা ভেঙে গিয়েছিল, ডাক্তার কেমন প্লাস্টার করে দিয়েছিল। সাহাকাকু এখন ঠিক হয়ে গেছে না, ঠিক আগের মতোই? বাবাও খুব শিগগিরিই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তবে যে মধুমাসি বলে গেল বাবার বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খুব বিপদ!’ সহজভাবে বলে গেল সাহেব।
‘না না। মধুমাসি তাহলে ভুল শুনেছে।’
মধুলিকার আচরণ এটাই শেখাল যে বন্ধুবেশী এরকম প্রতিবেশীর থেকে দূরে থাকাই ভালো। যারা কোনও কাজেই আসে না।
পরের দিন গোটা পাড়ায় সাহেবের বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি ঠিক তখনই এক এক করে পাড়ার পাঁচ-সাত জন বউ হাজির। এক একজনের, এক এক রকমের কথা। ‘বাচ্চাকে কী করে ছেড়ে দেয় মানুষ? আমাদের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাও তো খুব খারাপ। সবই অদৃষ্ট।’ জোরকদমে আলোচনা আর সহানুভূতির ঝড় বইতেই থাকল। কেউ আর যাবার নাম করে না। রামলালবাবুই এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচালেন আমাকে। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘কাকলি রেডি তো? চলো, দেরি হয়ে যাবে যে।’
আমিও তৎপর হয়ে উঠে পড়লাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, চলুন।’
আমার সঙ্গে সঙ্গে তারাও উঠে পড়ল। যেতে যেতে শান্তাদি বলে গেলেন, ‘দ্যাখো রামলালবাবু তো যথাসাধ্য করছেনই। তবুও যদি প্রয়োজন পড়ে বোলো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলব।’ আরও দু-তিনটে গলা শুনলাম। রামলালবাবুর স্কুটারে চেপে আমি আর তনু হাসপাতালে পৌঁছোলাম। বিকেলে সন্দীপের বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগরা এল দেখতে। সবাইয়ের একই কথা,কিছু দরকার লাগলে বোলো। ভেবে অবাক হয়ে যাই, দরকার হলে কেন, কেউ কি এগিয়ে এসে বলতে পারে না, নিঃসংকোচে বলো কী দরকার! একমাত্র রামলালবাবু ছাড়া। ওনাকে তো কোনও কথা বলতেই হয়নি। তার আগেই উনি বুঝেশুনে সব কাজ করে নেন। যেন সত্যিই বন্ধু নয়, সন্দীপ ওনার মায়ের পেটের ভাই। একটা দিনও রাত্তিরে উনি আমাকে হাসপাতালে থাকতে দেননি, সবসময় ছেলেমেয়ের দোহাই দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও রামলালবাবু ফল, ওষুধপত্র নিয়ে আসার পরে কিছু টাকা দিতে গিয়েছিলাম। তাইতেই উনি ভীষণ রেগে গেলেন। ‘আমি তো তোমাদের কোনও দিন পর ভাবিনি কাকলি। তাহলে এসব কথা উঠছে কেন?’
ওনার কথা শুনে অতীতের ঘটা একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি-ই তাচ্ছিল্য করে বলতাম, ‘সাহেববাবা, সাহেববাবা করে একেবারে গলে পড়ছে। রোজ রোজ আমাদের বাড়িতে ভালোমন্দ গিলে যাচ্ছে, অথচ বাচ্চাগুলোর জন্য একটা চকোলেট নিয়ে আসতেও ইচ্ছে হয় না, নীচ মানসিকতা।
আজ উনি আমাদের জন্য যা করছেন, অতি নিকটাত্মীয় হলেও বোধহয় এমনটা সম্ভবপর হতো না। নিজের ভাইকেও তো দেখলাম, অফিসের দোহাই দিয়ে কাটিয়ে দিল। আর অন্যান্য আত্মীয়দের তো কথাই আলাদা। কেউ নিয়মরক্ষা করতে মুখটা দেখিয়ে গেল মাত্র। আবার কেউ কেউ তো ফোনেই দায়িত্ব সেরে দিয়েছে।
রামলালবাবু যাওয়ার পর সন্দীপ বেশ ভাবুক হয়ে ওঠে। ‘সত্যি রামলালদা যদি না থাকত, কী হতো কে জানে। ও না থাকলে হয়তো হাসপাতাল পর্যন্তই পৌঁছোনো হতো না আমার।’ একটা চাপা শ্বাস নিয়ে চুপ করে যায় সন্দীপ।
ওনার সম্পর্কে বলার মতো ভাষা সত্যিই আমার জানা নেই। ওনাকে কী ভেবেছিলাম, আর উনি আসলে কী…। সত্যিই অসময়ে না পড়লে মানুষ চেনা বড়ো দায়। আজ অকপটে স্বীকার করতে বাধা নেই, উনিই আমাদের পরম বন্ধু।
অথচ ওই মানুষটাকে নিয়েই কতবার দ্বন্দ্ব বেধেছে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বারবার প্রশ্ন তুলেছি ওদের বন্ধুত্ব নিয়ে। আর জবাবে বারংবার একই উত্তর পেয়েছি, ‘মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না কাকলি। ও এত সহজসরল বলেই তোমরা ওকে উপেক্ষা করো। আজ পর্যন্ত কোনও কিছুর জন্য ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিহিংসার মনোভাব দেখিনি ওর মধ্যে।’
সন্দীপের কথাটা যে কতটা সত্যি, আজ আমি বুঝতে পারি। নয়তো আমার এত খারাপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও…।
সন্দীপ আগের তুলনায় অনেকটা ভালো হতে ছুটি দিলেন ডাক্তার। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে আরও মাস তিনেক কাটাতে হবে তাকে। রামলালবাবু ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন আমাদের। তারপর নিজে অফিস চলে গেলেন। অফিস ফেরত সোজা এলেন আমাদের বাড়িতে।
‘এখন কেমন?’ ঢুকেই ঠিক আগের ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করলেন আমাকে।
‘ঠিক আছে। আসুন।’
তনুও খেলতে যাচ্ছিল। রামলালবাবুকে দেখে আজ আর বেরোল না। সাহেব বই নিয়ে বসেছিল। ওনাকে দেখে উঠে এল। সবাইকে কাছে পেয়ে রামলালবাবু আবার পুরোনো ফর্মে। সেই ওনার ছোটোবেলার ঘটনা, খেতখামার, জমি, বাড়ি, গ্রামের হাজারও কথা। তবে আজ শ্রোতাবর্গ অনেক বড়ো। প্রতিবেশীদের দু-একজনও এসেছে সন্দীপ-কে দেখতে। সবাই মন দিয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, সত্যিই তো জীবনে কতই না কষ্ট পেয়েছেন উনি। বাবার মৃত্যুর পর কাকারা জোর করে জমি-জিরেত কেড়ে নিয়ে পথে বসিয়েছিল ওনাকে। সেই জায়গা থেকে আজকের হরদয়াল ইন্ডাস্ট্রির ইঞ্জিনিয়ারের সফর কতটা সংঘর্ষের সেটা ভেবেই ওনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাচ্ছিল আমার।
‘জেঠু তুমি বলেই পেরেছ। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পড়াশোনা শিখেছ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ। আমি তো এখনও মায়ের বকা না খেলে বই হাতে করি না।’ ছেলের মুখে একথা শুনে আমি বেশ অবাক।
‘সময় সব কিছু শিখিয়ে দেয় সাহেববাবা।’
সন্দীপ আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হয়তো আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারছিল। পরিস্থিতিটাও বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সব নিস্তব্ধ। কারও মুখে যেন বাক্যি সরছে না। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে রামলালবাবু ভাবলেন, ওনার কথায় আমরা বুঝি বোর ফিল করছি। তাই তিনি ওঠার উপক্রম করলেন। ঠিক সেই সময়েই মুখ দিয়ে অকপটে বেরিয়ে গেল, ‘বসুন না দাদা। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে কী করবেন? আমি আপনার জন্য তাড়াতাড়ি কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আনছি।’