Rain চিরকাল ভরসা জুগিয়ে এসেছে Bollywood ছবির নির্মাতাদের। একটি বর্ষার দৃশ্যে গানের পিকচারাইজেশনই হোক বা বর্ষনসিক্ত পোশাকে নায়িকার কন্ট্যুর-প্রকট উত্তেজক মুহূর্ত, দর্শক টানতে এই বর্ষাকেই বরাবর তুরুপের তাস করেছে বলিউড। বদলে গেছে দৃশ্যকল্প – বদলায়নি বর্ষার রোমান্টিকতা। ‘সাওন কা মহিনা পবন করে শোর’…. বর্ষার এই বিবরণ চিরকাল শোরগোল ফেলেছে হিন্দি ছবিতে।

আরকে মুভিজ-এর ভক্তরা তো একবাক্যে মেনেই নেবেন বর্ষার এই তাৎপর্যের কথা। ‘বরসাত’ ছবির সেই না ভোলা গান ‘বরসাত মে হম সে মিলে তুম’ কিংবা ‘শ্রী ৪২০’ ছবির কালজয়ী সেই গান ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া হ্যায়, প্যার সে ফির কিঁউ ডরতা হ্যায় দিল’ অমরত্ব লাভ করেছে সেলুলয়েডে। বর্ষা যে শুধু রাজ-নার্গিস জুটিকেই কালোত্তীর্ণ করে তুলেছে তা নয় – বর্ষার গানে বর্ষার দৃশ্যে যুগের পর যুগ পৌনঃপুনিক প্রেমের বীজ রোপণ করে গেছে বলিউড।

অমর দস্তাবেজ

বর্ষার প্রসঙ্গ উঠলেই মনটা কেমন নস্টালজিক হয়ে ওঠে শ্রী ৪২০-এর সেই গানে– ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া হ্যায়’। সে ছিল এক অদ্ভুত সংযমী প্রেমের জমানা, যেখানে একই ছাতার নীচে নার্গিস-রাজ বৃষ্টির দাপট সামলেছেন অথচ অশালীন ভঙ্গিমায় বাণিজ্যিক মুনাফা না লুটে। সেই সময়টাই ছিল সংযমী প্রেমের। আর ওই দৃশ্য ছিল এককথায় বৃষ্টির ফোঁটায় রচিত এক অমর দস্তাবেজ।

সেলুলয়েড সফরে পিছু হটলেই, দেখতে পাবেন, যে-কোনও রোমান্টিক দৃশ্য পর্দায় চিত্রায়িত হয়েছে গাছের আড়ালে প্রেমের লুকোচুরি খেলায়। প্রেমকে আরও গাঢ় গভীর করেছে বর্ষণসিক্ত মুহূর্তগুলি। রেন মেশিনের এই কামাল পর্দায় অপলক থাকতে বাধ্য করেছে দর্শকদের। সুন্দরী নায়িকার দীর্ঘ কপাল, গাঢ় চিবুক ছুঁয়ে গলার নীল শিরা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল, উদ্বেল করে তুলত সতেরোর নব যুবক থেকে একাত্তরের প্রৌঢ়কেও।

সে যুগে প্রেমের পরিভাষাটাই ছিল ভিন্ন। প্রেম-কে প্রেমের মায়াময়তা দিয়ে একটা রহস্যাবৃত ইন্দ্রজালে জড়িয়ে দর্শককে উপহার দেওয়াই ছিল পরিচালকের উদ্দেশ্য। ওই সময়টায় প্রেমকে যথাসম্ভব কামুকতা মুক্ত রাখারই চেষ্টা করতেন পরিচালকরা, কারণ সেলুলয়েডের প্রভাব সমাজে পড়ে। তাই সেলুলয়েডে ফুটে ওঠা দৃশ্যকে কলুষতামুক্ত রাখার ভাবনা কাজ করত ছবি নির্মাতাদের মনে।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই ভাবনাকে ভেঙে বৃষ্টিকে কামোত্তেজক দৃশ্যের হাতিয়ার করে তুললেন নির্দেশকরা। যুগ বদলের সঙ্গে রেন মেশিন ব্যবহূত হল বর্ষণস্নাত নায়িকার কনট্যুর প্রকট করার স্বার্থে, তাতে প্রেমের সঞ্চার কতটা হয় জানা নেই কিন্তু দর্শকের চিত্তচাঞ্চল্য হয় ও বক্স অফিসে কিঞ্চিত প্রাণ সঞ্চার হয় একথা নিশ্চিত।

পর্দায় মাইল ফলক

১৯৫৮ সালের ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’-র এক লড়কি ভিগি ভাগি সি’ গানের সেই ভিগি-ভাগি কন্যাকে মনে পড়ে! ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসি আর মদির চাহনিতে যিনি অনায়াসে দর্শকের বুকে সহস্র ছুরির ফলা গেঁথে দিতে পারতেন! হ্যাঁ মধুবালার সেই গায়ে লেপটে থাকা ভিজে শাড়ির ভাঁজে, না-জানি মিশে ছিল কত যুবকের বৃষ্টি ভেজা মনের না-বলা অভিলাষ। একদিকে কামোত্তেজক পোশাকে মধুবালার ওই উপস্থিতি, আর যাতে তার গায়ে কোনও ভাবেই সেনসরের চোখরাঙানির আঁচ না মেশে, তাই তা ব্যালেন্স করার জন্যই যেন কিশোর কুমারের ওই সিরিওকমিক ইমেজ– গানটিকে কালজয়ী করে তুলেছে।

‘রোটি কপড়া আউর মকান’ ছবির জিনতকে আজও ভোলা যায় না, যিনি ‘হায় হায় ইয়ে মজবুরি, ইয়ে মওসম আউর ইয়ে দূরী….’ গানটিতে শরীরী প্রেমের ভাষা জুড়ে দিয়েছিলেন। বৃষ্টি ভেজা জিনতের সেক্সি লুক সর্বকালের সেরা হয়ে আছে পর্দায়। এরই দু’দশক পরে এমন সিকোয়েন্স-কে দৃশ্যসফল করেছিলেন রবিনা ট্যান্ডনও ‘মোহরা’ ছবিতে। ‘মোহরা’ ছবির ‘টিপটিপ বরসা পানি’ গানে রবিনা ট্যান্ডন ও অক্ষয় কুমারের বৃষ্টিভেজা প্রেমের দৃশ্য, শরীরী শিহরণের এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আজও।

কুছ কুছ হোতা হ্যায়, রাজা হিন্দুস্থানি, ওয়েক আপ সিড, হাম তুম, দিলওয়ালে, তুম মিলে, কাইটস, রাভান ইত্যাদি বহু হিন্দি বলিউডি ছবিতে বৃষ্টিকে, অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

বর্ষার বহিপ্রকাশ

Bollywood ছবিতে প্রায় আট দশক ধরে আমরা Rain-এর নানাবিধ ব্যবহার দেখে এসেছি। মুশলধারে বৃষ্টি, আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গত করা বৃষ্টি, বর্ষণের রুদ্ররূপ, কিংবা নিছকই রোমান্টিক আবেগে শরীর-মন ভিজিয়ে দেওয়া ঝিরঝিরে বৃষ্টি। প্রেম, বিরহ, বিপদ সংকেত, হতাশা, উল্লাস বা প্রেয়সির সঙ্গে মিলন অভিসারের মুহূর্ত রচনা করে এসেছে ওইসব বর্ষণ দৃশ্য। ছবির মোড় ঘুরিয়ে দিতে নানা সময়ে সহায়ক হয়েছে বৃষ্টি। যেমন ‘আরাধনা’ ছবিতে এই বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখেই রচিত হয়েছিল রাজেশ-শর্মিলার প্রেমের সোপান, আর দর্শকরা উপহার পেয়েছিলেন কালোত্তীর্ণ সেই গান– ‘রূপ তেরা মস্তানা’। মেঘের কড়কড়ানি, বিদ্যুৎ ঝলক এবং পর্দায় সেই সেনসুয়াস বিভঙ্গ আজও সর্বকালের অন্যতম সেরা রোমান্টিক-মুহূর্ত করে রেখেছে ‘রূপ তেরা’ গানের দৃশ্যায়ন-কে।

পরবর্তীকালে নিজের চিরপরিচিত লুক ভেঙে ঠিক এরকমই সেনসুয়াস ইমেজে ধরা দিয়েছিলেন আর-এক অভিনেত্রী, স্মিতা পাতিল। ‘নমকহলাল’ ছবির সেই গান ‘আজ রপট যায়ে তো হমে না উঠাইয়ো’ গানের দৃশ্যায়নে। মায়াময় এক প্রেম-দৃশ্যে মুম্বইয়ের রাস্তায় হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন অমিতাভ ও মৌসুমি আরও এক চির অমর গান ‘রিমঝিম গিরে সাওন’-এর চিত্রায়নে। বর্ষাকে আবার বিরহবিধুর হূদয় ভাঙা একটি মুহূর্তে চিত্রায়িত করতে বড়ো সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন করণ জোহর ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ছবিতে। কাজল যেখানে খোলা মাঠের মধ্যে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনায় নুয়ে পড়েছেন আর ব্যাকগ্রাউন্ডে সেই হূদয় মোচড়ানো গান, ‘তুঝে ইয়াদ না মেরি আয়ে কিসিসে অব ক্যায়া কহনা’।

এভাবেই বছরের পর বছর বলিউডের ছবিতে বর্ষার ব্যবহার হয়ে এসেছে নানা মুড, নানা ঘাতপ্রতিঘাতকে পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তা সে, ‘ও সজনা বরখা বাহার আয়ি…’ বা ‘জিন্দগি ভর নেহি ভুলেঙ্গে উয়ো বরসাত কি রাত’ বা  ‘গুরু’ ছবির ‘বরসো রে মেঘা মেঘা’-ই হোক– প্রতিটি গানেই বর্ষার ভূমিকা প্রায় অনস্বীকার্য। মিরা নায়ার তো বর্ষাকে উদ্যাপন করার মাধ্যমে হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর আস্ত একটি ছবি, ‘মনসুন ওয়েডিং’।

৯০ -এর দশকে ভরপুর রোমান্টিসিজম এনে ফেলা সেই গানটা মনে আছে? ‘সাওন বরসে, তরসে দিল- কিঁউ না ঘর সে নিকলে দিল৷’ পর্দায় অক্ষয় খন্না ও সোনালি বেন্দ্রের প্রেমগাথা৷বা ‘তাল’ ছবির অনবদ্য কম্পোজিশন ‘তাল সে তাল মিলা..’ কিংবা ধরুন লাইফ ইন আ মেট্রো ছবির শাইনি আহুজা ও শিল্পা শেট্টির ওই প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্য– সেটা কি জমত অমন মুম্বাইয়া বারিশ না হলে?

হাল সময়ের ছবির মধ্যে কে ভুলতে পারে ‘বাগি’ ছবিতে শ্রদ্ধা কপূরের সেই বৃষ্টি ভেজা উদ্দাম নাচ, ‘নাচু আজ ছম ছম ছম…!’ বা পরিনীতি চোপড়া ও আসুষ্মান খুরানা অভিনীত’ মেরি পেয়ারি বিন্দু’ ছবির ওই আবেগঘন গানের দৃশ্য– ‘মানা কি হম ইয়ার নেহি, লো ত্যায় হ্যায় কে পেয়ার নেহি..৷’ বা ‘হাফ গার্ল ফ্রেন্ড’ ছবির গান ‘ইয়ে মওসম কি বারিশ,ইয়ে বারিশ কা পানি…’ বা নওয়াজউদ্দিন অভিনীত ‘বারিশ কী যায়ে’  যে-কোনও রেমান্টিক মানুষের মনে দোলা লাগাবেই৷

ভরসার বর্ষা

বৃষ্টির জলে বক্স অফিসে জোয়ার এসেছে, আরও এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ষাকে ব্যবহার করার গুণে। কৃষি প্রধান দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। বর্ষা সেখানে ভরসা জুগিয়ে একদিকে যেমন নিরন্নের মুখে অন্ন জুটিয়েছে, অন্যদিকে তা কৃষকের পরিশ্রমের মূল্যে, এনে দিয়েছে খেতভরা ফসল। হাতে তুলে দিয়েছে সম্মানের জীবন। ফিরিয়ে দিয়েছে কতশত আমভারতীয়র মুখের হাসি।

এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের জীবন কৃষিনির্ভর। বর্ষা এদের জীবনে রোমান্টিকতা নয় বেঁচে থাকার প্রধান রসদ। ফুটিফাটা মাটিতে বৃষ্টির জলবিন্দু নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। ঘরে ঘরে বয়ে আনে এক অমোঘ বার্তা – ‘আছে আছে প্রাণ আছে…’ জীবন ও জীবিকার প্রধান উপজীব্য হয়ে বৃষ্টি নামে কৃষকের বুকে, লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ধানের গোলায়।

মনে আছে ‘লগান’ ছবির সেই আত্মসম্মানের লড়াইয়ে সামিল মানুষগুলোর কথা? খাজনার বোঝা নামাতে যারা গোরা সাহেবের সঙ্গে কেতাদুরস্ত খেলায় সামিল হয়েছিল, নিছকই অপ্রশিক্ষিত অনাড়ম্বর গ্রাম্য অনুশীলনকে সম্বল করে? রুক্ষ মাটিতে এক বিন্দু জলের প্রতীক্ষায় মেঘ দেখে তাদের বৃষ্টির জন্য যে আকুতি-সেও তো পর্দায় অমর হয়ে রয়েছে ‘ঘননঘনন ঘন ঘের আয়ে বদরা, ঘন ঘন ঘোর কারে ছায়ে বদরা’। ফসল ফলবে খাজনার বোঝা নামবে, হাসি ফুটবে কৃষকের সংসারে। ওই দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে যেন হঠাৎ একটা ‘মিরাকেল’, একটা অভাবনীয় কিছুর সম্ভাবনা তৈরি করতে পেরেছিলেন পরিচালক। সেখানে বৃষ্টি যেন এক পরাবাস্তবতার প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছিল পর্দায়।

এমনই এক অপরিহার্যতা নিয়ে বৃষ্টি-কে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির ‘হরিয়ালা সাওন ঢোল মচাতা আয়া’ এবং ‘গাইড’ ছবির ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’ গানে। ভি শান্তারামের সর্বকালের সেরা ছবি ‘দো আঁখে বারাহ হাত’-এও বৃষ্টির আহ্বান আজও সুপরিচিত হয়ে আছে ‘উমড়ঘুমড় কর আই রে ঘটা’ গানটির মধ্য দিয়ে। বৃষ্টি এভাবেই জনজীবনে, আত্মায় মিশে আছে আমভারতীয়র, আর পর্দায় তারই সার্থক রূপ দেখে একাত্ম হন দর্শককূল।

বস্তুত বর্ষা আর বৃষ্টি নিয়ে গানের পিকচারাইজেশন এমনই অপরিহার্যতা লাভ করেছে হিন্দি ছবিতে, যে আজ আর এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সে প্রেমিক-প্রেমিকার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসাবেই হোক বা অনুর্বর জমিতে ফসল ফলানো – সেলুলয়েডে এমন অনেকানেক কৃতিত্বের জন্য বর্ষাকেই বাহবা দিতে হয়। যখনই বলিউডি সিনেমার ওই মায়াবি দুনিয়ায় বৃষ্টি ঝরবে, ভেজা মনে, আল্পুত হূদয়ে স্তব্ধবাক বসে থাকবেন দর্শকরা, এ কথা এতদিনে নিশ্চিত ভাবে জেনে গেছে ছবির নির্মাতারা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...