পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে, শূন্য আর ধরাতলে, মন বাঁধে ছন্দ আর মিলে/ বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী/ মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই নিঃশব্দে দিতেছে করতালি/আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, জানে তাকে এ কালিম্পং… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ত্রিস্রোতা বা তিস্তার অজগর প্রবাহের সঙ্গে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক সোজা রংপো হয়ে সিকিমের দিকে চলে গেছে। সেবক, কালিঝোরা, রম্ভিবাজার, রিযাং পার হয়ে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডান দিকে টার্ন নিলেই কালো চিতির মতো পাকদণ্ডি ১৫ কিমি পথটা আপনাকে কালিম্পং শহরে পৌঁছে দেবে। সবুজে মোড়া শৈলশিরাগুলি একের পর এক পালাক্রমে তিস্তার তীরে এসে পড়ছে। যাকে ভূগোলের টার্মে ইন্টার-লকিং স্পার বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা বলা হয়।
আকাশ ছুঁই ছুঁই পর্বতের চড়ার নিম্ন অববাহিকায় বেগবতি তিস্তা। দুই পাশে চুঁইয়ে পড়া সবুজ আর নদীর ভযংকর সৌন্দর্য আপনাকে নিমেষে আনমনা করে দেবে। কবির ভাষায়, কিছুই খুঁজিনি আমি যতবার এসেছি এ তীরে/ নীরব তৃপ্তির জন্য আনমনে বসে থেকে ঘাসে/ নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক।
বেশ কয়েক মাস আগে আমরা Kalimpong যাবার পরিকল্পনা করি। ঠিক করলাম শৈলশহরের উপনিবেশিক স্থাপত্যের ধ্রুপদি উদাহরণ মরগ্যান হাউসে রাত্রি বাস করব। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দফতরের মরগ্যান হাউসে তিনটি কটেজ বুক করেছিলাম। ভূতের কিছু গুজব গল্পগাঁথা আছে এখানে। কে ভূত দেখেছে জানি না! আমাদের তেমন কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি। গুজব গুজবই থাক।
আকাশে বেশ কয়েক দিন ধরে চড়া রোদ। আর সেই সময়ে শিলিগুড়ি থেকে আমরা মনোরম জলবাযুর শৈলশহর কালিম্পঙের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। এই সফরে আমরা তিনটি পরিবারের চারজন বাচ্চসহ মোট দশজন সদস্য। সকলকে নিয়ে আমাদের গাড়ি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কালিম্পঙের অভিমুখে। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে আপার কার্ট রোড ধরে কয়েক কিমি পাহাড়ি চড়াই উতরাই পার হয়ে আমাদের গন্তব্যস্থল সেই গা-ছম ছম মরগ্যান হাউসে উপস্থিত হলাম। নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় নীরবে ধ্রুপদি স্থাপত্য নির্মাণ মরগ্যান হাউসের অবস্থান।
আমরা কটেজে লাগেজ নিয়ে প্রবেশ করলাম। অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে রংবেরঙের ফুলের বাহার দেখতে পাবেন বিভিন্ন ঋতুতে। এখানের উদ্যানটি বেশ সুসজ্জিত। না কোনও গা-ছম ছম পরিবেশ না। বরং এক স্বর্গীয় উদ্যান মনে হচ্ছে। প্রাচীন হাউসের উপরে ও নীচে পর্যটক আবাস। পাহাড়ের গা বেয়ে কাঠের সুসজ্জিত আধুনিক লোভনীয় কটেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মরশুমে পর্যটকে ভরা থাকে।
প্রাচীন রেশম পথের অন্তর্গত নাথুলা ও জেলেপলার কাছে কালিম্পঙের অবস্থান। ১৯৪৭ সালের পর কালিম্পং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বত থেকে বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি নিয়ে আসেন এবং এখানে মঠ নির্মাণ করেন। নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা-সহ বিভিন্ন জাতি উপজাতির মহামিলন ঘটেছে কালিম্পঙে।
অর্কিড, ক্যাকটাস আর ফুলেদের উদ্যান হিমালয় কন্যা কালিম্পং। ফুলপরি শৈলশহরে যে-কোনও জীবন রসিক দুদণ্ড শান্তি পেতে পারেন। সবুজ উপত্যকার যেন ঢল নেমেছে মেঘেদের চুম্বনে। উদ্যান পালনে এই শহরের সুখ্যাতি আছে। উপত্যকার সহজ সরল অধিবাসীরা সারা বছর বিভিন্ন অর্কিড, ক্যাকটাস ফুলের ফলনে মেতে থাকে। স্ফিতকন্দ, রাইজমের ফলনে ব্যস্ত নার্সারিগুলো। অর্থনীতিতে ফুলের বাজার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কালিম্পঙের নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়ার আসর বসত বলে লেপচা ভাষায় যার অর্থ শৈলশিরায় আমরা খেলা করি। Kalimpong শব্দ এসেছে লেপচা শব্দ কালেনপাং থেকে, যার অর্থ Hillock of Assemblage অর্থাৎ ছোটো ছোটো পাহাড়ের গোষ্ঠী। সমুদ্রতল থেকে ২১৫০ মিটার উচ্চতায় মনোরম জলবাযুর শৈলশহরটি অবস্থিত। কালিম্পঙের কেন্দ্রীয় বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট (সিবিডি) ডেলো ও দুরপিন শৈলশিরাকে সংযুক্ত করেছে।
কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঐতিহ্যের ও কৃষ্টি সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহর। গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলি হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি ধন্য গৌরি নিবাস যা চিত্রভানু নামে পরিচিত। নির্জন পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত। এই ঘরে বসে কবিগুরু অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তাঁর লেখা জন্মদিন কবিতা আজ মম জন্মদিন/ সদাই প্রাণের প্রান্ত পথে / ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/… উচ্চারণে কালিম্পঙের সঙ্গে কলকাতার বেতার কেন্দ্রের সংযোগের উদ্বোধন করেন।
ম্যাক ফারলেন চার্চ, জেলার পুরোনো ভুটানি আশ্রম, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, বিভিন্ন হস্তশিল্পকেন্দ্র সকলের নজর কাড়ে। জ্যাং ঢোগ পালরি ফোডাঙ মনাস্ট্রি বৌদ্ধমন্ত্র উচ্চারণে এক ভক্তির পরিবেশ রচনা করে। এছাড়া বিভিন্ন ফুল ক্যাকটাস আর অর্কিডের নার্সারির সমাহার এখানে।
দুপুরের খাবার সেরে রওনা দিলাম ডেলো পাহাড়ের উদ্দেশে। শহরের প্রাণকেন্দ্র ছুঁয়ে Kalimpong-এর সর্বোচ্চ স্থান ডেলো হিল যার উচ্চতা ১৩৭২ মিটার। শহিদ দল বাহাদুর গিরি রোড ধরে ভূটান হাউসকে ডান দিকে রেখে মুল পথটা ইচ্ছে গাঁও, সেলারি গাঁ ও লাভার দিকে চলে গিয়েছে। একটা হেয়ার পিন বেন্ড পথ বাম দিকে ডেলো পাহাড়ের দিকে পাকদণ্ডি হয়ে উঠে গিয়েছে। আর এই পথের পাশেই পড়বে গ্রাহামস হাউস, বিজ্ঞান কেন্দ্র। আমরা ঠিক করলাম ফিরতি পথে দেখব স্থানগুলো।
ডেলো পথের পাশে ও মুখে প্রচুর প্যারাগ্লাইডিং কেন্দ্র রয়েছে। সম্ভবত আমাদের দেশে একমাত্র কালিম্পঙে প্যারাগ্লাইডিং সেন্টার রয়েছে। সাহসে ভর করে কিছুক্ষণের জন্য পাখির মতো মেঘ আর উপত্যকার স্বপ্নপুরীতে ঘুরে আসতে পারেন। এবার টিকিট কেটে বহু চর্চিত ডেলো পার্কে প্রবেশ। হিডেন জিলিয়া ফুল আর সবুজ ঢেউ খেলানো উপত্যকা আমদের স্বাগত জানাচ্ছে।
বিকালের সোনালি রং মাখা উদ্যানের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ডেলো রিসর্টকে পিছনে রেখে সেলফি আর ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করতে ব্যস্ত পর্যটকরা। আমার সফরসঙ্গীরাও বিভিন্ন পোজে সেলফি আর ছবি তুলতে ব্যস্ত। সর্বোচ্চ স্থান থেকে নিসর্গ সৌন্দর্য অবলোকনের একটা আলাদা স্বাদ আছে বই-কি।
পরিছন্ন আবহাওয়ায় ডেলো থেকে দেখতে পাবেন তুষার ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য, ঘন সবুজ উপত্যকার বুক চিরে তিস্তা, রেলি রিযাং নদীর উচ্ছল চলা। ধ্যানমগ্ন তুষার চড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য আলোর রং মেখে হাতছানি দেয় অহরহ। আলোর তুলিতে সোনা মেঘ এঁকে দেয় রকমারি ছবি। দূর পাহাড়ের শান্ত গ্রামীণ বসতি রেলি উপত্যকার গায়ে দেখতে দেখতে কিংবা উপত্যকার বুক চিরে কলভাষিণী তিস্তার ছুটে চলা মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় আমাদের।
এবার বিকালের নিভু নিভু আলো দেখতে দেখতে উপস্থিত কালিম্পং বিজ্ঞান কেন্দ্রে। এখানেও পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষণ সহায়ক সমূহ পরীক্ষা করতে পারে অনুসন্ধিত্সু শিক্ষার্থীরা। সবুজ মখমলে গা এলিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন। পরবর্তী দর্শনীয় স্থানে ড. গ্রাহামস হাউসে উপস্থিত আমরা। দুঃস্থ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছাত্রদের জন্য ড. গ্রাহামস হোমস এটি চালু করেন।
আমরা যখন সন্ধ্যার আলোয় মনে প্রাণে টগবগ করে উপত্যকার ফুলের মতো ফুটছি ঠিক তখনি খবর পেলাম শৈলশহর দার্জিলিঙের আকাশে রাজনৈতিক সংঘর্ষের কালো মেঘ জমেছে। কালিম্পং বাজার তখন সুনসান। পথে জটলা। পরদিন ১২ ঘণ্টার বনধ। পর্যটকদের সকাল ৬টার মধ্যে ফিরে যেতে হবে। যাইহোক এখানে কোনও অশান্তি না হলেও আমরা গন্তব্য মরগ্যান হাউসে ফিরে এলাম রাতের কালিম্পং দেখতে দেখতে। মরগ্যান হাউসের আগে চন্দ্রলোক বসতিতে এক দিদির দোকানে মোমো পাওয়া গেল।
এবার আমরা রাতের মরগ্যান হাউসের কটেজে যেখানে নির্জনতায় পাতা খসার শব্দ শোনা যায়। না কোনও ভূতের গল্প সত্যি হল না। বরং আলো ঝলমল মরগ্যান হাউসে দিব্যি রাতের কালিম্পঙের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। সুদূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে দীপাবলির আলোর রূপ চুঁইয়ে পড়ছে উপত্যকার গা বেয়ে। রাতের খাবার সেরে আমরা ভোরের অপেক্ষায় শুয়ে পড়লাম। কারণ ভোর চারটায় শিলিগুড়ি রওনা দিতে হবে।
গায়ে ভোরের আলো মেখে পাহাড় ছাড়লাম। খুবই পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র কালিম্পং। সরকারি, বেসরকারি হোটেল লজের অভাব নেই এখানে। যে-কোনও ভ্রমণরসিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের শহর ও ফুলের উপত্যকা Kalimpong খুব সহজেই ঘুরে আসতে পারেন।