পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। স্কুলে যদি টেস্টে অ্যালাউড হতে না পারে তাহলে যে কী অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে নিজেও জানে না। স্যারের কথামতো বাড়িতে তো রাজি করিয়েছিল কিন্তু ভালোমতো জানত কোনওরকম ভাবে যদি রেজাল্টে লাল কালির দাগ পড়ে তবে পড়াশোনার ইতি এখানেই এ বছরই হবে। কেউ কোনও কথা শুনবেই না। দস্তুরমতো নিজের যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। পড়ার বাইরে আর এতটুকু কথা বলার সুযোগ দিত না স্যারকেও। খুব ভয় লাগত। মনে হতো কিছু যেন একটা ঘটবে। অথচ নিজেকে কিছুতেই সরিয়ে আনতে পারত না, পারছিল না।
পরীক্ষার ঠিক এক সপ্তাহ আগে, ততদিনে যতটা পেরেছে ইংরেজি দেখে নিয়েছে। সজল স্যারের কোচিংয়ে যাবার আর কোনও প্রশ্নই ছিল না। ইতিহাস আর পলিটিক্যাল সাযে্সের আগের বছরের কোশ্চেনগুলো থেকে প্রভাস স্যার কিছুটা দাগিয়ে দেবেন বলেছিলেন। মোটামুটি ইম্পর্টেন্টগুলো পরীক্ষার আগে দেখে গেলেই হবে।
স্যারের বাড়ি ঢুকতেই দেখে কোনও এক আত্মীয়ে বাড়ি স্যার আর কাকিমা তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছেন। কস্তুরী বাড়ি ঢুকতেই বলেন, শোনো আমি তোমার জন্য কয়েকটা নোট বের করে রেখেছি। ওগুলো সব আমার সময়ে। তাই এত ভাজা ভাজা হয়ে গেছে, তুমি বাড়ি নিয়ে যাওয়া অবধি আর কিছু গোটা থাকবে না। আমাদের তিনজনকেই যেতে হচ্ছে। নীচে তো মা রইল। লেখাগুলো বেশি বড়ো নয়। তুমি টুকে নিয়ে মাকে বলে নীচের দরজাটা টেনে দিয়ে চলে যেও, অসুবিধা নেই তো?
না স্যার। সত্যি অসুবিধা ছিল না। নিরিবিলিতে একটু থাকতে পাওয়াটা যে কত বড়ো সুখের সেটা জানত কস্তুরী। স্যার আর ওনার স্ত্রী, ছেলে চলে যাওয়ার পর স্যারের পুরোনো খাতাটা দেখছিল। স্যার ঠিকই বলেছেন। একেবারে হলুদ খাজা একটা ঠোঙা।
পাতা ওলটাতে গেলেই মড়মড় করে আওয়াজ হচ্ছে। পাতাটা কুঁকড়ে ভেঙে ভেঙে আছে। তবে ভগবানের দয়ায় লেখাটা অতটা অস্পষ্ট হয়নি। তাই বুঝতেও পারছে, বুঝে টুকে নিতেও পারবে।
লিখতে লিখতে বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধে নেমেছে খেয়ালই হয়নি। লেখাটা আর একপাতা মতো বাকি ছিল। আচমকা খুট করে একটা শব্দ হওয়ায় পেছনে ফিরে তাকাতেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় কস্তুরীর। ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে বুম্বা স্যার। ও ঘরে ঢুকল কী করে?
আপনি? আঁতকে উঠেছিল কস্তুরী।
ছেলেটার চোখ দুটো যেন জ্বলছিল। কী অসম্ভব ধূর্ততা লেগে ছিল ওঁর চোখে। কস্তুরী অবশ হয়ে আসা ভয়গুলোকে দূরে ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে এখনই এই মুহূর্তে ওকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নাহলেই সর্বনাশ।
বাড়ি ফিরবে কী করে? স্যারের মা সন্ধ্যা প্রদীপ দিতে নীচে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছেন হয়তো। এই ঘর থেকে চিত্কার করলে তিনি কোনওমতেই শুনতে পাবেন না। এক এক পা করে বুম্বা স্যার ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কস্তুরী চিত্কার করবে? কী করবে ও…?
টেবিল আর বুম্বা স্যারকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে বেরোতে গিয়ে ঝনঝন করে একটা শব্দ হয়। আহঃ! পায়ে কী যেন একটা ফুটে যায়। যন্ত্রণা… হাঁটতে পারছে না… চোখে অন্ধকার অন্ধকার ঠেকছে। সারা শরীর শিথিল হয়ে আসছে। কাচের গেলাসটা টেবিলের ওপরেই ছিল। কস্তুরীর শরীরের ধাক্কাতেই খানখান হয়ে ভেঙে গেছে। পায়ের তলায় ফুটে গেছে টুকরোর কিছুটা।
আহঃ…। পুরো ঘরটাই অন্ধকার হল কী করে? কিছু দেখতে পাচ্ছে না কস্তুরী। স্যার কি আলো নিভিয়ে দিল? ওকে এখান থেকে উঠে দাঁড়াতেই হবে। চেষ্টা করে দাঁড়াতে চাইছে, পারছে না। কে যেন ওর পা দুটোকে রগড়ে টেনে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। সমস্ত শরীরটা কাটামাছের মতো ঝটপট করছে। লোকটা অসুরের মতো শক্তি দিয়ে মুখটা একহাত দিয়ে চেপে ধরে আরেকটা হাত দিয়ে এলোপাথাড়ি খুঁড়ে যাচ্ছে শরীরের সমস্ত ঢাকা অংশ। কোনও ভাবেই কী এর থেকে মুক্তি নেই…?