শেষে ফোনটা ওর ভাই ধরেছিল। আশপাশ থেকে বাড়ির অনেকের হই-হুল্লোড় শুনতে পাচ্ছিল। আসলে ওই দিনটা ছিল বিশেষ একটা অনুষ্ঠানের দিন। ওর মায়ের জন্মদিন ছিল, এত কিছু জানলে কস্তুরী ফোনই করত না। সবাই মিলে সারপ্রাইজ বার্থডে পার্টি রেখেছিল সকাল থেকেই। পুরো অ্যারেঞ্জমেন্ট-টাই স্বাগতা আর ওর ছিল। ছোটো ছেলেটার মুখ থেকে যখন একের পর এক এসব শুনেছিল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি কস্তুরী। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আচমকাই শিকড়শুদ্ধু ওকে উপড়ে নিয়েছে।

এদিকে বাড়ি থেকে মা-বাবার তাড়া, দিদির বারবার ফোনের কারণে মামারবাড়ি চারটে দিনের বেশি থাকতে পারেনি। বাড়ি ফিরে এসেছে। আবার সেই একই রুটিন। একই ভাবে হোঁচট খেতে খেতে পথ চলা। এটাই ওর নিয়তি এটাই ওর ভবিতব্য। এটাকে যত তাড়াতাড়ি মানতে শিখবে তত কষ্ট কম পাবে। তবে কখনও কখনও দিম্মামার কথা শুনে মনে হয় এত কিছু ঘটে গেলেও জীবনের ওপর কখনও বীতশ্রদ্ধ হতে নেই। জীবনটা অনেকটা বড়ো। তার থেকে পাওয়ার আরও কিছু বাকি আছে।

কস্তুরীর দিম্মামা বলেন, লোভ-হিংসা- রাগ করে আখেরে লাভ কিছুই হয় না। পুরোটাই একটা গোটা শূন্য। যা কিছু মানুষ কেড়ে বাগড়ে নিয়ে নেয় সেসব তো ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে। কেউ তো কারুর সম্পত্তি ঐশ্বর্য আমরণ সঙ্গে রেখে দিতে পারবে না। সেটা সম্ভবও নয়।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, মানুষ জন্মে আত্মা অবিনশ্বর, সে কেবল পুরোনো জামা থেকে নতুন জামা পরার মতো এক শরীর থেকে বেরিয়ে আরেক শরীরে যায়! তাই জীবনের যা কিছু মানুষ নিজের বলে মনে করে তা আদপেই তার নয়। সেটা ক্ষণিকের মায়া বই আর তো কিছুই নয়। একটা নির্দিষ্ট সার্কেলে পৃথিবী শুরুর দিন থেকে এটাই ঘটে চলেছে। এক মাটিতে মিশে যাচ্ছে মানুষের শরীর, আবার সেই মাটি থেকেই জন্ম হচ্ছে নতুন প্রাণের।

দিদির সঙ্গে মনোমালিন্যের দিনগুলো, বাড়িতে আঘাত পাওয়ার দিনগুলো, ছোটোবেলার ছোটোবড়ো কষ্টের দিনগুলো তাই কস্তুরীর দিম্মামাই সামলেছেন, বুঝিয়েছেন। সেসময় দিম্মার কথাগুলোর মানে বুঝতে না পারলেও এখন অনেকটাই বোঝে ও। এসব পুরোনো দিনের অনেক কথাই মনে নতুন করে উত্সাহ জাগায়। অনুপ্রেরণা হয়ে ফিরে আসে। কস্তুরী কি পারবে না সব কিছু ডিঙিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে? বাঁধাধরা সিলেবাসের বাইরে সম্পূর্ণ একটা নিজস্ব পরিচয়। যেটার সমস্ত কৃতিত্ব থাকবে ওর!

দিম্মামা বলেন ওঁনার নিজের মায়ের কথা, পরপর চারটে সন্তানের অকালমৃত্যু হওয়ায় ভদ্রমহিলা শোকে পাথর হয়ে অন্ধ হয়ে গেছিলেন। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে রঙিন জগত্টা কালো হয়ে গেছিল একসময়, তাও জীবনের সেই প্রবল ঝড়ে নুইয়ে পড়েননি। ভেঙে পড়েননি। একা হাতে মানুষ করে গেছেন তার নাতি-পুতিদেরও। এমনকী বড়ো নাতির তো বিয়ে দেখে গেছেন। আসলে প্রতিটা মেয়ে জীবনেই একটা ঢাকা অংশ থাকে। অজানা গল্প থাকে। কেউ সেটাকে পরম যত্নে লুকিয়ে রাখে। কেউ ঢাকা খুলে মেলে ধরে সমাজের সামনে।

বাবু তোর ফোন এসেছে। কলেজের কোনও বন্ধু…। কস্তুরীকে ডাকে ওর মা।

বন্ধু? তবে কী ও…। বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে ওঠে। যদি হয়…। চোখের পাতার নীচের অংশটা জ্বালা জ্বালা করে। বুজে আসা গলায় জোর এনে বলে, হ্যালো…।

কী রে এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে? ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে রিমলি।

রিমলি। বোকার মতো কারুর অপেক্ষা করছিল! কী করে এখনও দুহাতে আড়াল করে রেখেছে ছোট্ট আশার সলতেটা…।

এই তো বল।

আরে বিএম স্যার রাজি হয়েছেন আমাদের পড়াতে। তবে থার্ড ইয়ারের একটা ব্যাচ আছে মঙ্গলবারে। ওটাকে উনি সাইজ করে নেবেন। আমাদের ধর ওই যেতে হবে মঙ্গলবার কলেজ ছুটির পর। কী রে রাজি তো?

হুম ওনার ফিজ কত করে?

৪০০ টাকা করে।

আমরা তো আটজনই পড়ব। কলেজে আয়, ডিটেইলে আলোচনা করব।

ওকে, রাখছি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...