বিয়ের পর ভারতীয় মেয়েদের দুরাবস্থার খবর আমাদের আশেপাশে, খবরের কাগজে প্রায়শই চোখে পড়ে, বিশেষ করে পাত্র যদি বিদেশে বসবাসকারী হয়। এর কারণ হচ্ছে মেয়ের পরিবারের লোকজন পাত্রের ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান।

নির্মলা পুণাতে থাকে। ওর মা আর ওখানকার মহিলা সমিতির মেম্বার বনানী খুব ভালো বন্ধু, সেই সূত্রে নির্মলার সঙ্গেও বনানী আন্টির ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন কথায় কথায় নির্মলা নিজের মেয়ে সঞ্চিতার বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছে জানাতে, বনানী আন্টি নিজের ভাইপো সমরের কথা বললেন। পাত্র বর্তমানে আমেরিকায় থাকে এবং ওখানে খুব ভালো চাকরি করে। বনানীর কথায় নির্মলা জানতে পারল— সমরের জন্যও পাত্রী সন্ধান করা হচ্ছে।

বাড়িতে স্বামী এবং মেয়েকে সমরের কথা জানাতে, নির্মলার স্বামী একটু ইতস্তত করলেও, সঞ্চিতা কিন্তু বিদেশে থাকা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। ওদিকে বনানীও সমরকে ফোনে সঞ্চিতার ছবি-সহ ওর সম্পর্কে, সবকিছু জানাতে সমরও কথা দিল পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পিসিকে জানিয়ে দেবে। বনানী পাত্র-পাত্রী উভয়কে ভিডিও চ্যাটে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বেশ কিছুদনি ওরা ফোনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে সবকিছু ঠিক মনে হতে, নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়ে দিল উভয়ে বিয়েতে রাজি আছে।

বিয়ের দিন স্থির হতে সমর এক মাসের ছুটি নিয়ে পুণা এসে পৌঁছোল। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করাই ছিল। সমর ও সঞ্চিতার বিয়ে হয়ে গেল। সমরের কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়ে সঞ্চিতার মা-বাবা বনানীর উপর ভরসা করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

ভরসা করার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, শৈশবে এক দুর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারিয়ে সমর তার বনানী পিসির কাছেই মানুষ হয়েছিল। অবশ্য টাকা-পয়সার জন্য বনানীকে চিন্তা করতে হয়নি। মা-বাবার অকালে মৃত্যু হওয়াতে ওই শিশু বয়সেই সমর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র মালিক হয়ে উঠেছিল। বিধবা নিঃসন্তান বনানী, সমরকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করাতে সমরের বাবার তৈরি ট্রাস্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাতা হিসেবে বনানীকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অর্থের লোভে বনানী সমরকে দত্তক নিলেও ওকে মানুষ করতে কোনও কার্পণ্য করেননি। ভালো স্কুল থেকে পড়াশোনা করিয়ে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন সমরকে। একুশ বছর বয়সে সম্পত্তির অধিকার সমরের হাতে চলে আসায়, ধীরে ধীরে সমরের স্বভাব পালটাতে থাকে। সে ঠিক করে আমেরিকায় গিয়ে পাকাপাকি বসবাস করবে।

সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে চাকরি নিয়ে সমর আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং ওখানেই থেকে যাওয়া মনস্থির করে। এত বছর বাদে বিয়ের জন্য দেশে ফিরেও বিয়ে মিটতে না মিটতেই সঞ্চিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসে ও।

কী করে দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়, নতুন বিয়ের আনন্দে সঞ্চিতা বুঝতেই পারে না। রোজই মনে হতো সমরকে বিয়ে করে সারা বিশ্বের সুখ ওর মনের কোণায় জমা হয়েছে। একদিন হঠাৎ-ই সঞ্চিতা বুঝতে পারে যে, সে মা হতে চলেছে। এর পরেই ঠিক করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তবে সমরকে জানাবে। ডাক্তার সব রিপোর্ট পজিটিভ জানালে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সঞ্চিতা। অধীর আগ্রহে সমরের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে সবকিছু সমরকে বলার জন্য।

সন্ধেবেলায় সমর বাড়ি ফিরলে সবথেকে আগে সঞ্চিতা এই আনন্দ সংবাদ সমরকে জানায়। কিন্তু ওর মুখে আনন্দের বদলে অন্যকিছু চোখে পড়াতে সঞ্চিতা ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। সমরের মুখের এই ভাবান্তর আগে কখনও সঞ্চিতা দেখেনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সমর নিজেকে সামলে নিল। সঞ্চিতাকে দুই হাতে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, আমি তো বিশ্বাস করতেই পারছি না যে আমি বাবা হতে চলেছি। খবরটা শুনে কিছু মুহূর্ত আমার ব্রেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি এখন থেকে খুব সাবধানে থাকবে। আমার পরিচিত একজন ভালো গাইনিকোলজিস্ট আছেন, কাল আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব সম্পূর্ণ চেক-আপের জন্য।

পরের দিন সঞ্চিতার যখন চোখ খুলল, দেখল অপরিচিত একটা বিছানায় ও শুয়ে আছে। কোমরের নীচের থেকে একটু ভারী ভারী মনে হচ্ছিল, পেটেও একটা সামান্য ব্যথা ছিল। চারপাশে চোখ বোলাতে মনে হল কোনও হাসপাতালের ঘরে ও শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করেও শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারল না। সেই মুহূর্তে একজন নার্স দৌড়ে এসে বলল, আপনি আরও খানিক্ষণ বিশ্রাম করুন। তিন ঘন্টা পর আপনি উঠতে পারেন।

হাসপাতালের বিছানায় ও কীভাবে এল জানতে, কাউকে না পেয়ে নার্সকেই জিজ্ঞেস করাতে নার্স একটু অবাক হল। নার্স সঞ্চিতার দিকে একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, আপনি জানেন না আপনার কী হয়েছে? আপনার অ্যাবর্শন হয়েছে।

শুনেই সঞ্চিতার মাথা ঘুরে গেল। ওর মনে পড়ল সমরের সঙ্গে ও হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট-এর কাছে এসেছিল চেক-আপ করাতে। ওখানে ওকে জল খেতে দেওয়া হয়েছিল তারপরেই ওর খুব ঘুম পাচ্ছিল। ব্যস আর কিছু ওর মনে নেই। এখন পুরো ঘটনাটাই সঞ্চিতার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...