“এখন সবাই একটু কিছু মুখে দাও।’’ গম্ভীর মুখে কথাটা বললেন সিদ্ধার্থ।
ঘরের সবাই অবাক চোখে তাকাল তাঁর দিকে। বলে কী লোকটা! মাথার ঠিক আছে তো? বাবার মৃত্যুর পর তিন ঘন্টাও কাটেনি। কোভিডে মৃত্যু, তাই ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ পায়নি কেউ। শুধু ওখানে উপস্থিত তাপস আর নিলু দূর থেকে প্ল্যাস্টিকের মোড়কে আটকানো বাবার মুখটা দেখতে পেয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল ওদের লোকেরাই। কাঁদতেও পারেনি ওখানে। বাড়িতে ফিরে আসার পর একচোট কান্নার রোল উঠেছিল। সময় কান্নার জল শুষে নেয়। অন্তর গুমরে উঠলেও জল সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একসময়। মাঝে মাঝে একটু নাক মোছা চলছিল, ঠিক তখনই সিদ্ধার্থ কাকুর এই কথা!
কান্না পর্ব শেষ। এখন চলছে শোক স্তব্ধতার পর্ব। পর্বের সমাহারই জীবন। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলেনি। মনে মনে হয়তো সিদ্ধার্থকে তুলোধনা করছিল। এইসময় এরকম একটা কথা বলা যায়? লোকটা মানুষ না জানোয়ার? অথচ যিনি মারা গিয়েছেন তিনি তো তাঁরই বাল্যবন্ধু। একটা মানুষ মরে গেল আর ওর কাছে খাওয়াটাই বড়ো হল? তিনি বিচক্ষণ, তিনি আবার একজন অধ্যাপক!
সময় আর কিছুক্ষণ সময় নিল, তারপরেই নিজের খেল দেখিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ মনে মনে কষ্ট পেলেও জানতেন এটাই হবে। শোক আসলে একটা ঝোড়ো হাওয়া, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
তাপসদের মিনু মাসি খবর পেয়েই চলে এসেছেন লকডাউন উপেক্ষা করে। খুব বেশি দূরে থাকেন না বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বললেন, “যে গেল সে তো আর ফিরে আসবে না। ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসছে। কী ভালোমানুষ ছিলেন জামাইবাবু। সবই নিয়তি। তোরা চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি করিসনি। কিন্তু দাদার কথাটাও মানতে হবে। সবশুদ্ধু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলে কেমন করে চলবে? সামনে কত কাজ। আমি বরং ফ্রিজ থেকে কিছু ফল বের করে রাখি, একটু গরম হবে।’
সময় আর শোকের খেলা জমে উঠছে। এতক্ষণ শোক একচেটিয়া মাঠ দখল করে খেলছিল, এবার শিথিল হচ্ছে তার আধিপত্য, খেলা ধরছে সময়।
তাপসের বউ অপর্ণা বলল, ‘ফলগুলো ভালো করে স্যানিটাইজ করতে হবে। আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে, চলুন।
শোকের চেয়ে বড়ো কর্তব্য। জীবন থাকলে কর্তব্য থাকবে। যে মরে যায় তার সঙ্গে সবাই তো একসঙ্গে মরতে পারে না। জীবন-মৃত্যুর টানাটানিতে যে যেদিকে থাকবে, তাকে সেখানেই লড়াই করতে হবে।
সিদ্ধার্থ সে অর্থে এ বাড়ির কেউ নন। আবার অন্যদিক থেকে অনেক কিছু। মৃত হরিশ মুখার্জির বাল্যবন্ধু তিনি। অকৃতদার। নিজের পরিবার বলতে এক আধপাগল ভাই, একটা পোষা কুকুর, আর রান্নার কাজের লোক রামের মা। রামের মায়ের আসল একটা নাম আছে বটে কিন্তু সেটা ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড আর আধার কার্ডের বাইরে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করার সুযোগই পায় না। মজার ব্যাপার, তিনি নিজেও সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যান।
সিদ্ধার্থ ফিলোজফির অধ্যাপক ছিলেন। বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। বন্ধু হরিশের পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসেন। তার কারণও আছে একটা। সিদ্ধার্থের মা মারা গিয়েছিলেন শৈশবেই। সেই সময় থেকে হরিশের মা তাকে মাতৃস্নেহ দিয়েছিলেন। সখির ছেলে বলে কথা! সবাইকে বলতেন, ওরা দুজন আমার দুই সন্তান। ওদের বলতেন— আমি যখন থাকব না, তোরা দুজনে দুজনকে দেখে রাখবি।
হরিশের ডায়াবেটিস ছিল। কিছুদিন আগে হার্টের কিছু মাইনর সমস্যাও ধরা পড়েছিল। ইদানীং একটুতেই হাঁপিয়ে যেতেন। তবুও থেমে থাকেননি। বয়সের সিম্পটম বলে দিব্যি ইগনোর করে যাচ্ছিলেন। তবে করোনার আবির্ভাবে সবার মতো হরিশও ভয় পেয়েছিলেন। যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করে চলার চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার, ঘরবন্দি হয়ে থাকা, নিয়ম করে গার্গেল করা, প্রোটিন, ভিটামিন সি, কোনও কিছুই বাদ দেননি। তবুও তিনি করোনা আক্রান্ত হলেন। প্রথমে সর্দি, কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, তারপরে এল জ্বর। হাউজ ফিজিশিয়ান ডাক্তার মিত্র বললেন, ‘টেস্টটা করিয়ে নিন।’
টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ। হালকা শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। পুরো এলাকা তখন কনটেইনমেন্ট জোন। কেউ কোথাও যেতে পারে না, কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না, সে এক মহা বিড়ম্বনা। এক একটা বাড়ি যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সন্ধ্যা হতেই কোলাহলের শহরে মৃত্যুপুরীর নির্জনতা নামে। টিভি আর মোবাইল বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
দশ দিন লড়াই করার পর হেরে গেলেন হরিশ। হেরে গেলেন জীবনের কাছে। মাঝখানে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তখন দু’বেলা ফোন করতেন সিদ্ধার্থকে। বাড়ির খবরাখবর নিতেন। আর বলতেন, এবার ফিরলে এটা করব সেটা করব, কত প্ল্যান! আসলে আইসোলেশন পর্বে হরিশ পিছনের জীবনটাকে দেখার, মূল্যায়ন করার অখণ্ড অবকাশ পেয়েছিলেন ওখানে। দূরে গেলে কাছটাকে দেখা যায়, একদম খাঁটি সত্য। কাছ থেকে কাছটাকে দেখাই হয়ে ওঠে না! হঠাৎ করে একটা লোক আবার অতটা সিরিয়াস হয়ে গেল কী করে কে জানে, চলে গেলেন হরিশ। হরিশের ছেলেরা হসপিটালের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু এই ডামাডোলে ধোপে টেকেনি।