সিদ্ধার্থ জানেন হরিশের ছেলেরা ওঁকে খুব একটা ভালোবাসে না। বিশেষ করে ছোটো ছেলে তপনের সঙ্গে একদমই বনিবনা হতো না। বড়ো দুজনেরও যেটুকু আছে সেটা অন্তরের নয়, কেজো আর লোক দেখানি ভালোবাসা। মাঝে মাঝেই বাবা-মাকে নিয়ে টাগ অফ ওয়ার চলে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর মতো কথাও ওরা বলে, সিদ্ধার্থের কানে এসেছে। হরিশও সব জানত।
বৈঠক বসেছে সামনের ঘরে। হরিশের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনার জন্য।
হরিশের বড়ো ছেলে তাপস বলল, ‘বাবা গলদা চিংড়ি খুব ভালোবাসতেন। আমার ইচ্ছে ছিল মৎসমুখীতে গলদা চিংড়ি হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে খাওয়ানো তো দূরের কথা, অনুষ্ঠান করা যাবে কিনা সেটাই সন্দেহ। পুলিশ পঁচিশ-ত্রিশের বেশি লোকের পারমিশন দেবে না।”
সিদ্ধার্থ বললেন, “কী দরকার? নিষ্ঠা নিয়ে শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম কর, তাহলেই তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। গলদা চিংড়ি খাওয়ালেই আত্মা শান্তি পাবে, কে বলেছে তোদের? গুরুদশা পার হল, এবার বাকি কাজগুলো কীভাবে করা যায় সেটা ভাব৷’
মেজ নীলু বলল, ‘তবুও লোকে ঠিক বলবে ছেলেগুলো কিপটে…।’
“কেন বলবে? লোকে পরিস্থিতি জানে না? ওটা তোর মনের ভুল ধারণা। বরং উলটোটা হবে, ডাকলেও কেউ আসবে না। আর যদি এতই খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকে তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে না হয় খাইয়ে দিস।’
ছোটো ছেলে তপন বলল, ‘আমাদের কপালটাই খারাপ। কী ট্রিটমেন্ট হল কে জানে, গুচ্ছের টাকা খেয়ে লোকটাকেও মেরে ফেলল। শালা হারামির…।’
তপনের বউ রীতা কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, ‘হচ্ছেটা কী? সবাই রয়েছে এখানে। মুখের ভাষা কি তোমার কোনওদিনই ভালো হবে না?”
হরিশের মেয়ে নীপা বলে, ‘ছোড়দার মুখের ভাষা হয়তো খারাপ কিন্তু অন্যায্য তো কিছু বলেনি। ব্যাবসা করার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে। তাও যদি বেঁচে ফিরত।’
সিদ্ধার্থ বিরক্ত গলায় বললেন, “তোরা কি আবার ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাস? তবে একটা কমপেনসেশন কেস ঠুকে দে৷ জিতে গেলে অনেক টাকা ফেরত পাবি ৷ ‘
“সেটাই তো উচিত ছিল।’ রাগে গজগজ করতে করতে বলল তপন।
মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। এসব কি বাবার প্রতি ভালোবাসা, নাকি পাহাড় প্রমাণ বিলের জন্য হতাশা? যতদূর জানেন সিদ্ধার্থ, হরিশ নিজের চিকিৎসার জন্য একটা বড়ো অ্যামাউন্ট সব সময় রেডি রাখত। হয়তো তার বাইরে কিছু দিতে হয়েছে তাই রাগ সামলাতে পারছে না এরা। কিন্তু একদিক থেকে এদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কারণ বৃদ্ধ বাবাকে আমৃত্যু টানার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে হরিশ। কতটা পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় এখনও বুঝে উঠতে পারেন না সিদ্ধার্থ। মানুষের মনোভূমিতে চাহিদার বিষবৃক্ষ কতটা বেড়ে উঠলে সম্পর্কগুলোকে নস্যাৎ করে শুধু চাহিদার কথাই ভাবতে থাকে— তার পরিমাপ আজও শিখলেন না। হরিশের মৃত্যুশোক ধীরে ধীরে টাকার শোকে পরিণত হচ্ছে। এই তো মানুষের অস্তিত্ব!
‘এসব কথা মায়ের সামনে বারবার তুললে তাঁর মনে কতটা আঘাত লাগে তোরা বুঝতে পারিস? বাবা গেল, মাকেও খুঁচিয়ে মারতে চাস? এমন করলে আমাকে আর ডাকিস না। সত্যি কথা বলতে এ বাড়িতে আমার আসার আর কোনও কারণ রইল না।”
তাপস কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না কাকু। আপনি এরকম বললে আমরা খুব কষ্ট পাব। বাবা নেই, এখন আপনিই আমাদের গার্জিয়ান।’
হাসতে গিয়েও কোনওরকমে নিজেকে সামলালেন সিদ্ধার্থ। এই মুহূর্তে হাসলে বড্ড বেমানান দেখাত। বেড়ে মিথ্যে কথাটা বলেছে ছোকরা! মরার ক’দিন আগেই হরিশ ফোনে চরম এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘জানি না আমি আর ফিরতে পারব কিনা, তোকে একটা গোপন কথা বলতে চাই।’ তারপরে সংকোচ ভরে বলেছিলেন, “জানি না বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তবুও বলছি কারণ একজন মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে যুক্তিতর্কের চেয়ে সত্যটা স্বীকার করার মধ্যে প্রাণের আরাম বেশি মনে হয়। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে। শোন সিদ্ধার্থ, আমার মৃত্যু হলে তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না। একদিন এক ঝগড়ার সূত্রে তাপস কি বলেছিল জানিস? বলেছিল, তোমরা যাকে এত প্রশ্রয় দাও সে তো আসলে লম্পট, চরিত্রহীন। ছোটো থাকতে ও নাকি দেখেছে, তুই নাকি ওর মার সঙ্গে একই বিছানায়… আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানি ওটা ওর বানানো গল্প। ও সব পারে। আমি বেঁচে থাকতে যেটা পারেনি সেটা আমার অবর্তমানে ঠিক করে দেখাবে।”
শোনার পর কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি সিদ্ধার্থ। সুতীব্র গ্লানিতে ভরে গিয়েছিল মন। এটা শুনতেও বাকি ছিল তাঁর! দু’দিন এতটাই তোলপাড় ছিল মন, হরিশের বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত মাড়াননি। পরে হরিশের অনুরোধেই আবার গিয়েছিলেন। হরিশ আকুতি মিশিয়ে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আসিস।”