প্রায় ঘন্টাদুয়েক পরে জ্ঞান এল অবন্তীর। সবাই ঘুরে আসার পর শেষে গেল ফাল্গুনী। ওদের বাড়ির সবাই সবই বোঝে, কিন্তু না বোঝার ভান করে। ঘরে ঢোকার পর ফাল্গুনী দেখল, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে আছে অবন্তী। আলতো করে মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, অবন্তী…কষ্ট হচ্ছে?

বোজা চোখটা অর্ধেক খুলল, দ্রুত একটা মোটা জলের ধারা দুচোখ থেকে বেরিয়ে এল। মনে হল অনেক কিছু ধুয়ে নিয়ে গেল। তারপর ধীর গতিতে মাথা নেড়ে না বলল, কিন্তু কোনও শব্দ হল না। এবার ফাল্গুনী হাতটা ধরে বলল, একটা দিন একটু কষ্ট করো, কাল ঠিক হয়ে যাবে।

অবন্তী আবার ঘাড় নেড়ে না বুঝিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারল না, ঘুমিয়ে পড়ল।

বাইরে বেরিয়ে বহুদিন পর সিগারেট ধরাল ফাল্গনী। অতনু জিগ্যেস করল, কী হল?

—না… কিছু না, তবে ভালো লাগছে না।

—আরে দূর, অ্যানেস্থিশিয়া করেছে না, কালকে ঠিক হয়ে যাবে।

—তুই বুঝবি না, ওর কষ্ট হচ্ছে।

—বাবাকে বলব? তুই কি রাত্তিরে ওর কেবিনে থাকবি?

—না ইয়ার্কি নয়, বিশ্বাস কর আমি বলছি ও কষ্টে আছে।

পরদিন সকাল এগারোটায় ভিজিটিং আওয়ার। অনেকেই এসেছে। এক এক করে দেখা করে আসছে। সবাই এসে বলছে, ভালো আছে। ভালো লাগছে ফাল্গুনীর। আজও সবার শেষে গেল ফাল্গুনী। খাটে উঠে বসেছে অবন্তী। গঙ্গাজল রঙের একটা সামনে চেরা নাইটি। জানলার একটা কাচ দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে একদিকের গালে। মনে হচ্ছে এদিকটা দিন, অন্য গোলার্ধ। আর একদিকটা গম্ভীর, অন্ধকার।

—কেমন আছো, অবন্তী?

—তোমার কলেজ নেই?

এবার হাত ধরে ফাল্গুনী বলে উঠল, কী হল আবার?

—আমার বাবা আছে, দাদা আছে, তুমি সারাদিন এখানে পড়ে আছ কেন? তোমার পড়াশোনা নেই। এরপর রেজাল্ট খারাপ হবে। দোষটা তো আমার হবে। তুমি এখন যাও। বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিল অবন্তী।

নতুন এক অবন্তীকে দেখল ফাল্গুনী। সম্পূর্ণ অচেনা। প্রেমের সুতো দিয়ে

যে-নকশাটা আঁকা হচ্ছিল হঠাৎ যেন হাত লেগে রঙের দোয়াতটাই উলটে গেল। তাও মনকে বোঝাল শরীর ঠিক না থাকলে কি মেজাজ ঠিক থাকে? আস্তে করে বেরিয়ে কলেজের পথে হাঁটা দিল ফাল্গুনী।

দুদিন পর ছুটি হল অবন্তীর। বাড়ি এল। ফাল্গুনী দেখা করতে গেল। অবন্তী একটা বই নিয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। চোখের নীচে কালি। মিষ্টিমুখটায় চন্দ্রগ্রহণ। ঠোঁটদুটো শুকনো। দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ফাল্গুনী জোর করেই বলল, কিছু হয়েছে অবন্তী?

—হলেই বা কী করবে? আমি তোমার কে?

—আমি তোমার কথার এক বর্ণও বুঝতে পারছি না।

—বোঝার তো দরকার নেই, নিজের চরকায় তেল দাও।

কথা বাড়াল না ফাল্গুনী। এরপর সম্মানহানি হবে। আস্তে করে বেরিয়ে এল। প্রায় দিন পনেরো গেল না ওই বাড়িতে। একদিন স্কুলফেরত দেখা হল অবন্তীর সাথে। মিষ্টি হেসে বলল, মঙ্গলবার একটু আসবে, সন্ধেবেলা, একটা নতুন গান তুলেছি, শোনাব।

মেঘ ভেঙে রোদ উঠল ফাল্গুনীর মনে। চিত্কার করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। সবকিছুই সুন্দর লাগছে। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। চারিদিকেই যেন খুশি আর আনন্দ।

তারপরই সেই মঙ্গলবার, রাখিপূর্ণিমার দিন। তবে সেদিন যেটা ঘটল, তাতে নির্বোধরা আত্মহত্যা করত, বেসামালরা নেশা, আর যাদের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে যেমন ফাল্গুনী ডুবে গেল নিজের পড়াশোনায়, সঙ্গে দর্শন আর আধ্যাত্মবাদ। এইভাবেই দিন কাটতে লাগল। অতনুর সাথেও অনেকদিন দেখা হয় না।

অতনু একদিন ফাল্গুনীর বাড়িতে উপস্থিত। এসে বলল, তোর কী খবর রে? কোনও যোগাযোগ নেই।

—না এমনিই। কী আবার হবে?

—তুই ভুল বুঝছিস। আমাদের বাড়ির সবার মন খারাপ। বুনির (অবন্তী) রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টটা ভালো নয়। ও হিমোফিলিয়া-র বাহক। ডাক্তারবাবু বলেছেন বিয়ে পর ছেলেমেয়ে হলে সমস্যা হতে পারে।

ফাল্গুনীর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ সময় নিল, তারপর বলল, আমাকে এতদিন পরে বললি!

—না, কী ভাবে বলব ভাবছিলাম।

ক্রমশ…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...