মাথা নীচু করে বসে রইল ফাল্গুনী। পরেরদিন অতনুদের বাড়ি গেল ফাল্গুনী। এত বেপরোয়া আগে কোনওদিন মনে হয়নি। বাড়িতে ঢুকে অতনুকে বলল, অবন্তীর সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। অতনু বলল, যা ওপরে আছে।

দরজাটা বন্ধ রয়েছে। দুবার আলতো টোকা দিল ফাল্গুনী, অবন্তী… অবন্তী।

আস্তে করে দরজা খুলল, বয়স বেড়ে গেছে অবন্তীর, চুল খোলা, চোখের পাতা কিছু ঝরে গেছে, গভীর নয়, ফাঁক ফাঁক, বাকিগুলো নুইয়ে আছে। গাল দুটো বাসি বিয়ে মালার মতো, ঠোঁট দুটো ঈষৎ কাঁপছে। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে জড়িয়ে ধরল ফাল্গুনী। বহুদিন পরে কেঁদে ফেলল। অবন্তী মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গেল। তারপরই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ফাল্গুনী ভেজা গলায় বলল, আমি কিছু বুঝি না, আমি তোমাকে চাই।

—না, ফাল্গুনীদা তা হয় না। আমি গান ভালোবাসি। এই লাইনের লোকের সাথেই আমার মানানসই। আমি মৈনাককে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভুলে যাও।

—আমি পারব না অবন্তী।

—সেটা আমার কিছু করার নেই। পাগলামো করে লাভ নেই। অনেক ভালো মেয়ে আছে। তুমি সুখী হবে।

ভালো মানুষ আর মনের মানুষের তফাত অবন্তী বুঝতে পারছে না, বা পারছে, বুঝতে চাইছে না। মাথা নীচু করে ফাল্গুনী বেরিয়ে এল। শরীরে মন কোথায় থাকে বুঝতে পারছে ফাল্গুনী, কারণ বুকে একটা মোচড় দিচ্ছে। জীবন, এক পথ ছেড়ে অন্য পথের দিকে বেঁকে যাচ্ছে। নিজের ভেতর অনেক গুটিয়ে গেল ফাল্গুনী।

এদিকে অবন্তী দিল তার নারীত্বের পরিচয়। নারীমন দেবা ন জনন্তি।

কদিন আগের যন্ত্রণার থেকেও মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে অবন্তীর। কোথায় হচ্ছে, বুঝতে পারছে না। কিন্তু শরীর মন এই ঝড়ে কিছুতেই দাঁড়াতে পারছে না। মনের সব প্রদীপগুলো নিভে যাচ্ছে একে একে। শরীর ভারী হয়ে আসছে। কান্না আসছে না। অশ্রুনদী বইতে গেলে মনের কোণে যে-হিমবাহটা লাগে সেটাই শুকিয়ে গেছে। মনের হিমাঙ্ক অনেক নীচে নেমে গেছে। যার তল খুঁজে পাচ্ছে না অবন্তী। শুধু দিশেহারার মতো শান্তি খুঁজছে।

॥ ৪ ॥

এদিকে মৈনাক রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। সে অবন্তীর শরীর চায়। অবন্তীর ভাঙা মন শরীর দিতে চায় না। ফাল্গুনীর মনে ঘৃণা জন্মানোর জন্য যেটুকু দরকার ছিল অবন্তীর তা মিটে গেছে।

এবার ও নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু মৈনাক ছাড়বার পাত্র নয়। একদিন বাবা-মা দাদা গেছে বিযোড়ি। অবন্তীর এখন বাইরে খাওয়া বারণ। ও যায়নি। বাড়িতে একা। মৈনাক এসে হাজির। অবন্তী প্রথমে ভেবেছিল ঢুকতে দেবে না। তারপর শালীনতায় আটকাল। জড়তা নিয়ে দরজা খুলল। হারমোনিয়াম পেতে বসল। গানে মন নেই আজ। হঠাৎ তবলা ছেড়ে উঠে এল মৈনাক। জড়িয়ে ধরল অবন্তীকে, ঘাড়ের কাছে ঠোঁট ঘষতে লাগল, অস্ফুট স্বরে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসি।

বয়সের ধর্মে দূর্বল হয়ে পড়ছে অবন্তী। মৈনাকের দুটো হাত অবন্তীর শরীরের অলিতে গলিতে বযঃসন্ধির স্পর্শ খুঁজছে। অবন্তী নিজেকে ছাড়াতে চাইছে, কিন্তু দূর্বল হয়ে পড়ছে। হঠাৎ কপালে একটা চুম্বন করল মৈনাক। অবন্তীর সারা শরীরে একটা তরঙ্গ খেলে গেল। ফাল্গুনীর মুখটা ভেসে উঠল। হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল অবন্তী। ঘাবড়ে গেল মৈনাক। ছিটকে সরে গেল। ভয় মেশানো গলায় বলে উঠল, কী হল?

অবন্তী হাত জোড় করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও।

মৈনাকের চরিত্র দৃঢ় নয়, ফলে মন দূর্বল। ভয় পেল। চোরের মতো চলে গেল। মৈনাকের এ-বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল অবন্তী। তাতে শরীর বাঁচল। কিন্তু মন ধীরে ধীরে খুশির রসদ না পেতে পেতে ক্রমশ মুষড়ে যেতে লাগল। একটা উচ্ছল অষ্টাদশীর পালকের মতো মন বুকের মাঝে, খুলতে ভুলে যাওয়া মৃত্যুদিনের পরানো মালার মতো ঝুলতে থাকল। মনোবিদ দেখাতে হল অবন্তীকে। অনেক সময় লাগল সুস্থ হতে।

ক্রমশ…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...