এর মধ্যে চার-চারটে বসন্ত পার হয়ে গেল। কত পুরোনো পল্লব ঝরে গেল, আবার সেই জায়গায় কত কচি পাতা এসে ভরে দিল। এটাই নিয়ম। এটাই স্বাভাবিক। এখনও মাঝেমধ্যে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায় অবন্তী। শরীর, মন, বয়স অনেক পরিণত। বিকেলের সূর্য‌্য ঢলে পড়েছে। ঠিক ডুবে যাবার আগে একটা আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে, ওই হলুদ বাড়িটার চিলেকোঠায়। ওই বাড়িটায় ফাল্গুনীরা থাকত। বহুদিন চলে গেছে। তবু তাকিয়ে থাকে ওই ছাদে টাঙানো তারের দিকে।

হ্যাঁ ঠিক, ওখানেই ফাল্গুনীর পানাফুল রঙের শার্ট টানটান করে দেওয়া থাকত। কাক বসলে রাগ হতো। আজও ঝুলছে একটা সাদা শার্ট, কার জানা নেই। কিন্তু গোধূলির আলোয় মনে হচ্ছে পানাফুল। আলো কমে আসছে। একটা ছায়া-শরীর পায়চারি করছে। হয়তো ওই বাড়ির কেউ। ঠিক ফাল্গুনীর মতো হাঁটার ভঙ্গিটা। না, ডাক্তারবাবু এসব ভাবতে বারণ করেছে, মনে মনে ভাবল অবন্তী। মাথার ওপর একটা কাক কর্কশ স্বরে ডেকে ঘরে ফিরছে।

বাস্তবের মাটিতে মনকে নামিয়ে আনল অবন্তী। নীচে নেমে এল। সামনে বিএ ফাইনাল। মন দিয়ে পড়তে বসল। নিজের পায়ে ওকে দাঁড়াতে হবেই।

॥ ৫ ॥

আরও বছর চারেক লাগল অবন্তীর চাকরি পেতে। অনেক দূরে, মথুরাপুরের কাছে অবন্তীর স্কুল। অবন্তীর মামা থাকে বাগবাজারে। মাহিমা একদিন একটা পাত্তরের খবর নিয়ে এল। পাল্টি ঘর, ব্যাংকে কাজ করে ছেলেটি। যৌথ পরিবার। শরিকি বাড়ি বাগবাজারে। তবে হাঁড়ি আলাদা। অবন্তীর বাবা-মার বেশ পছন্দ। অবন্তীর কোনও মত নেই। তার মন মতামতের উর্ধ্বে

ছেলে মানে, লোক বলাই ভালো, দেখতে এল অবন্তীকে। অবন্তীকে দেখার কিছু নেই। ঈশ্বর তাঁর রূপের ডালি ঢেলে দিয়েছেন ওর শরীরে। অবন্তীর রক্তের ব্যাপারটা জানানো হল। এতে ছেলের কোনও আপত্তি নেই। অবাক হল অবন্তী। যাইহোক দু-বাড়িই রাজি হয়ে গেল। অবন্তীর সিঁথিতে ফাল্গুনীর দেওয়া আবিরের দাগটা যেটা শুধু অবন্তীই দেখতে পায়, সেটা এক কলকাকলি ভরা সন্ধ্যায় ঢেকে গেল অবনীর সিঁদুরে।

কপালে সিঁদুর পরলে, মেয়ে থেকে নারী হওয়ার যে-অনুভতি শরীরে খেলে যায়, সেটা অনুভব করতে পারল না অবন্তী। তবে বেশ বনেদি পরিবার অবনীরা। বউভাতে অবন্তীর গা-ভরা গয়না, লাল বেনারসি, বিরাট কাঁসারের বগি থালায় ভাত, সারি সারি কাঁসারের বাটি। সব-ই ঠিক আছে। সবকিছুই মেঘলা আকাশের মতো সূর্য‌্যকে ঢেকে দিতে চাইছে। কিন্তু কোথা দিয়ে যে মেঘ ছিঁড়ে একটু রোদ এসে মনটা উদাস করে দিচ্ছে অবন্তী বুঝতে পারছে না।

চোখ ভিজে যাচ্ছে। সবাই ভাবছে বাপের বাড়ির শোকে। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে, মেযো হল টবের গাছ, যখন যেখানে তখন সেখানের মতো। কিন্ত গাছটাই যে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যাচ্ছে, তার খবর কেউ রাখল না।

ফুলশয্যার রাত। অবনী দরজা দিল। নারীর নতুন জীবন। কোনও পুরুষের সাথে একা একটা ঘরে। এই দুদিনে অবন্তী একটা জিনিস বুঝেছে, মানুষটা খারাপ না। জটিল নয়।

হাউ-হাউ করে কথা বলে, নিজেও হাসে, হাসাতেও ভালোবাসে। অবনী ঘরে ঢুকে বলল, এই এ বাড়িতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? অবন্তী মাথা নাড়ে।

অবনী আবার শুরু করে, এই জানো আমার বন্ধু পল্টু এত বদমাইশ, বলে কিনা, নানারকম ফল দিয়ে খাট সাজাবে, বলে ফুল তো বিয়ে আগে ফোটে, বিয়ে পরে তো ফল। সাজালে কী সাংঘাতিক কাণ্ড হতো বলো? এবার অবন্তী হেসে ফেলল। বুঝল মানুষটা একেবারেই সরল। না হলে, নতুন বউয়ে কাছে কেউ এ গল্প করে।

তারপর অনেক রাত অবধি নানা মজার গল্প করল অবনী। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে অবনী। অবন্তী এবার একটু জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে, আবার স্বাভাবিক থাকারও চেষ্টা করছে। মন আর শরীর এক বিন্দুতে মিলছে না। সেই বিন্দুতে অন্য ছবি আঁকা রয়েছে, ঝাপসা কিন্তু গভীর। অস্পষ্ট তবুও অনস্বীকার্য। তারপর যেটা হল, সেটাকে শারীরিক সম্পর্ক না বলে একতরফা কর্ম সমাপন বলাই ভালো। মোটামুটি এই ভাবেই চলতে লাগল পরের দিনগুলো।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...