অবনী খেতে খুব ভালোবাসে। বাঁচার জন্য খায় না, খাওয়ার জন্য বাঁচে। নানারকম বাজার করা, রান্নাবান্না, পূজা-পার্বণ আর নানা ছুতোয় হই হই করে তিন-চার বছর আরও কেটে গেল। রসিক মানুষ অবনী। সারাক্ষণ হাসিখুশি। রসবোধ থাকলেও, নারীমনের সম্পূর্ণতা যে মাতৃত্বে সেই বোধটা নেই। অনেক ডাক্তার দেখানো হল, সমস্যাটা অবনীর। আজকে হলে, হয়তো সেটা সমাধান হতো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সেটা অকল্পনীয়। ছন্দহীন জীবনে গতানুগতিক দিন কাটতে লাগল।
সুখের দিনগুলো সেকেন্ডের কাঁটার মতো ছোটে। ভালো না লাগা দিনগুলো কাটতে চায় না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেন ঘন্টার কাঁটা। তা-ও ধীরে ধীরে বিয়ে ফটোটা পুরোনো যুগের মানুষের মতো লাগে। সাজগোজ, জামা-কাপড়, ফটোর ভঙ্গি কেমন যেন সেকেলে হয়ে যায়, সবারই হয়। এটাই নিয়ম। তা-ও ভালো লাগে, যদি বর্তমানটা সুন্দর হয়। কোনওমতেই অবন্তীর গর্ভে কোনও সন্তান এল না। নিজের ফাঁকা পৃথিবীতে উলটে একে একে বাবা, তারপর মাকে হারাল।
অতনুর এখন ভরা সংসার। এক ছেলে, এক মেয়ে বউদি ভালো। তবুও বাপের বাড়ির শিকড়ের টান অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে অবন্তীর। দেখতে দেখতে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। এদিকে অবনীর একবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। হাই সুগার। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার কোনও বাঁধন নেই। অনিয়ম চলতেই লাগল। ওষুধপত্র ঠিকঠাক খায় না। একদিন ভোররাতে সেরিব্রাল অ্যাটাক হল অবনীর। তিনদিন পর সব শেষ। স্বামী কেমন, সেটার থেকেও বড়ো হল স্বামী থাকা আর না থাকা। এই দুটোর তফাত বুঝল অবন্তী। বৈধব্য মানে শুধু সিঁদুর মোছা নয়। ভেতরের মনটাও সাদা হয়ে যায়। একাকিত্ব গ্রাস করতে লাগল অবন্তীকে। আবার মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তখনই স্কুলের এক কলিগের হাত ধরে এই সংস্থায় আসা।
॥ ৬ ॥
আজ আকাশটা ভিজেভিজে। কিন্তু বৃষ্টি নেই। গঙ্গা গর্ভবতী, তবু শান্ত, তবে গম্ভীর। সূর্য আজকের মতো বিদায় নিচ্ছে। শেষ দাহর সিঁদুর ছড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চিম আকাশে, গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ছে অবন্তীর ফরসা হলদেটে নিরামিষ গালে, কাঁচাপাকা আলগা খোঁপার বাঁধনটা সোনালি লাগছে। একগাছি সোনার চুড়ি চিকচিক করছে বিকেলের নরম আলোয়। হাতের ওপর চিবুক রাখা।
মাঝগঙ্গা দিয়ে একটা নৌকা যাচ্ছে, কোন পাড়ে লাগবে বোঝা যাচ্ছে না। অবন্তী একবার ভাবছে এই মঠে সবকিছু ছেড়ে যোগদান করবে। সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। পারবে কি সে এপথে চলতে? সে পথ বড়ো বন্ধুর। আবার পরক্ষণেই মনে পড়ছে, বাবার দেওয়া সেগুন কাঠের খাট, নকশাকাটা আলমারি, এক বাক্স বাসন, কত ভরি গয়না এসব ছেড়ে চলে আসবে?
কত কঠিন, যারা পারে তারা কি অতিমানব? কিন্তু এগুলো আঁকড়ে রেখেই বা কী লাভ? সন্ধ্যা নামার মতো খাদের গাম্ভীর্য নিয়ে একটা গলা আস্তে কিন্তু গভীর সেই স্বর, অন্তর্যামীর মতো হঠাৎ বলে উঠল, অবন্তী…।
এই মঠে এতদিন আসছে অবন্তী। এই প্রথম সরাসরি কথা বলল ফাল্গুনী। অবন্তীর গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরল না। অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল, কী…? বালিকার মতো সেই প্রশ্ন।
—তুমি এখানে আসবে অবন্তী? এ সংসারে সুখ আছে কিনা জানি না, তবে শান্তি অপার। এটা জগৎ সংসার। এর সেবায় শুধুই আনন্দ। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের আনন্দ। তোমার ভালো লাগবে।
—আমি পারব?
—কেন পারবে না? আমি তো আছি।
টুপ করে চাঁদটা কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এল। সারা আকাশ, বাতাস, নদীর জলে জ্যোত্স্না গড়িয়ে পড়ল। অবন্তী সারা শরীরে যেন মুহূর্তের মধ্যে ভরা কোটাল। মনের মধ্যে বেঁচে থাকার জোয়ার। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে চন্দন রঙের শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে বলল, আমি আসছি।
ফাল্গনী দেখল, একটা অশ্রুকণা গালের উপর চাঁদের রুপোলি আলোয় চিকচিক করছে, পঁচিশ বছর আগে যেটা নার্সিংহোমে দেখেছিল। ওই জলবিন্দুটার ভেতরে মনে হচ্ছে গঙ্গার থেকেও বেশি জল ধরা আছে। পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের সেই বিন্দুতে অর্চনা আর প্রেম মিলিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার ওপারে কোন ২২শে শ্রাবণের মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে, দুজনে দেখা হল, মধুযামিনী রে…।
সমাপ্ত