যেমন সময়ে রোজ ঘুম ভাঙে, আজও ভাঙল কাবেরীর। পাশে অমলেন্দু নেই। তার মানে আরও সকালে উঠে কথামতো শুরু করে দিয়েছে নিজের কাজ। ব্রাশ করে রান্নাঘরে যাবার আগেই দেখল, ট্রে-তে চায়ের কাপ ডিশ, বিস্কুট সাজিয়ে শোবার ঘরে অমলেন্দু হাজির।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই কাবেরীর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। জিভটায় যেন কেউ কারেন্ট মারল। লিকার অত্যধিক কড়া। তার উপরে গুড় গোলার মতো মিষ্টি। এক কথায় বিচিত্র স্বাদ। গোটা সকালটাই একেবারে তেতো হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখ করে অমলেন্দু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ছোটোবেলায় বাবা শিখিয়েছিল, “মর্নিং শোজ দ্য ডে!’

সকাল যখন এইভাবে শুরু হল, গোটা দিন কীভাবে যাবে, ভাবতে গিয়ে ভেতরে কেঁপে উঠল কাবেরী। অথচ কাল রাতে খাবার টেবিলে বসে চোখ বুজে কাবেরীর হাতে তৈরি তরকা-রুটি চিবোতে চিবোতে অমলেন্দু যখন বলেছিল, ‘সারা সপ্তাহে তো একদিনও বিরাম পাও না। ভাবছি, কাল গোটা দিনটা কিচেন সামলাব আমি।’

রুটির গ্রাস মুখে তুলতে গিয়েও নামিয়ে নিয়েছিল কাবেরী। আঠারো বছরের বিবাহিত জীবনে যাকে কোনওদিন রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরোতে দেখেনি, সে সারাদিনের হেঁসেল সামলাবে! অমলেন্দু’র প্রায় টাক মাথায় কয়েকগাছি চুল সুন্দরবনের বিরল হয়ে আসা সুন্দরী গাছের মতোই জেগে আছে। সে দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ব্যাঁকা হাসি হেসে কাবেরী বলেছিল, ‘যদ্দুর জানি তোমার তো ডিগ্রি বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ছিল, হোটেল ম্যানেজমেন্টে তো নয়।’ বড়ো জালার মতো ভুঁড়িটা কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল অমলেন্দু,

—আরে, না না গিন্নি। এই লকডাউনে আমাদের তো তাও ওয়ার্ক ফ্রম হোমে কিছুটা বাঁচোয়া। যেমন, ট্রেন, বাসে জার্নির ঝক্কিটা এখন নেই। কিন্তু তোমাদের? তোমাদের তো লকডাউনে খাটা-খাটনি কিছু কম হয়ে যায়নি। আমি হাজব্যান্ড হিসাবে একটু ব্যতিক্রমী হতে চাই।

সোহাগ করে ‘গিন্নি” কথাটা অমলেন্দু’র মুখে শুনলেই কাবেরীর মনে ‘কু’ গায়। নিশ্চিত ভাবে কিছু ধান্দাবাজির গন্ধ পায়। লকডাউন, ভাইরাসের অ্যাটাক তো এ বছর বা এই কয়েক মাসে হয়েছে। বছরের পর বছর ঘুরে গেল। কাবেরীর রান্নাঘরের ঝক্কি সামলানোর কথা কোনওদিন ভাবেনি অমলেন্দু। খেতে ভালোবাসে। ছুটির দিনে বাজার থেকে ফিরে বরং একস্ট্রা কোনও মাছের পদ রাঁধার কাতর অনুরোধ জানিয়ে, হয় টিভির খবরের চ্যানেলের সামনে বসত, আর না হলে সোশ্যাল নেট ওয়ার্ক সাইটে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। তার হঠাৎ এই ভক্তিভাব জেগে উঠল কেন বুঝতে না পেরে কাবেরী প্রশ্ন করেছিল,

—বটে! তা তুমি তো হাতা-খুন্তিই কোন দিকে ধরতে হয় জানো না। করবেটা কী করে?

বউয়ের এই মনোভাবের কথাটা বিস্তর বোঝে অমলেন্দু। রীতিমতো হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, ‘ধুস! তুমি জানোই না। আমি তো লকডাউনের মধ্যেই একটা কুকিং কোর্স করে নিয়েছি।”

—কুকিং কোর্স! কোথা থেকে? অবাক ভাবটা যাচ্ছিল না কাবেরীর।

—কোথা থেকে আবার! ইউটিউব থেকে। কোর্সটার দর্শনই ছিল, “বিরতি দিন বউকে’।

কাবেরী হাঁ করে ফেলেছিল মুখটা — আবার দর্শন !

গলার স্বর ভাসিয়ে বলে উঠেছিল অমলেন্দু, ‘অফকোর্স। লকডাউন তো শুধু ভাইরাস তাড়াতে বন্দিদশা নয়। কোর্সে বলা হয়েছে, নিজের জীবনকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখাও।”

এ বার ভয় পেয়েছিল কাবেরী। টাকা রোজগার করতে শিখলেও অমলেন্দুর সংসার সামলানোর নমুনার সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই পরিচিতি ঘটেছে এতগুলো বছরে। বিয়ের দু’মাসের মাথায় ব্লাউজের হাতা ফিটিং করাতে দর্জির কাছে নিয়ে গিয়েছিল। পরতে গিয়ে দেখেছিল হাতা জুড়িয়ে দু’টো আঙুল ঢোকানোর মতো মেরে কেটে জায়গা রেখেছিল।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...