বছর দুয়েক আগে পেট খারাপ হয়ে মেয়ে তিন্নি বেশ অসুস্থ। কাবেরী অমলেন্দুকে ডাব এনে কেটে জল আনতে বলেছিল। ফ্ল্যাটের সিকিউরিটির কাছ থেকে হাতুড়ি আর বাটালি যোগাড় করে ডাব ফুঁড়ে জল বের করার অপারেশন শুরু করেছিল। হাতুড়ি সপাটে মারতেই বাটালি ডাবের পেছন ফুটো হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর সে বাটালি বের করার জন্য সিকিউরিটির ঘরে করাত চাইতে যায় অমলেন্দু। সিকিউরিটি দেখে শুনে হাওয়া।
এ ছাড়া ইস্ত্রি করতে গিয়ে বার দুয়েক জামাকাপড়ের বারোটা বাজানো, নেল পলিশ শুকিয়ে যাওয়ার পর গাড়ির পেট্রোল ঢেলে তরল করার চেষ্টা— শেষ কয়েক বছরে কাবেরী ভয়ের চোটে অমলেন্দুকে ঘর সংসারের কোনও কাজ করতে বলে না। নিজেও জানে, ওকে কিছু এ ধরনের কাজ করতে বলা মানে পরে নিজের খাটনি কয়েক গুন বেড়ে যাবে। তো এই অমলেন্দু যখন রান্নাঘর সামলানোর কথা নিজে থেকে বলল, কাবেরীর লো ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছিল। তিন্নি অবশ্য বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল তুলে বাবাকে বলেছিল, ‘আমি আছি।’
কাবেরী ভালোমতোই জানে, ক্লাস ইলেভেনে পড়া মেয়ে বাবাকে কত হেল্প করবে! পড়াশোনার সময়টুকু বাদ দিয়ে মোবাইল সার্ফিং-এ যে-স্পিডে হাত চলে, তার সিকিভাগও ঘরের কাজে চলে না। এ ব্যাপারে মেয়ে একেবারে বাবার কনফার্মড জিন পেয়েছে। ‘থামস আপ’ করা মানে তিন্নি আসলে যে কাঁচকলা দেখিয়েছিল, অফিসের জটিল ম্যানেজমেন্ট সামলেও অমলেন্দুর মাথায় ঢোকেনি।
ফলে আজ সকালে এই চা যখন বাবা সার্ভ করছে, মেয়ে নিজের বিছানায় পা বালিশের সঙ্গে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কবাডি খেলছে।
মুখটা বিচ্ছিরি লাগছে কাবেরীর। তাও স্বাভাবিক মুখ করে অমলেন্দুর মুখের দিকে তাকাল, ‘তা আজ দুপুরে আর রাতে কী রান্না হবে? কাল তো বলেছিলে, সারপ্রাইজ দেবে।’
মুখ আর টাকের ছাঁটা বাগানে যেন একটা উজ্জ্বল আলো খেলা করল অমলেন্দু’র। অতি উৎসাহে আছে বোঝাই যাচ্ছে। সকালে উঠে চান করে স্যান্ডোগেঞ্জি আর বারমুডা পরে যেভাবে ময়দানে নেমেছে, একটা কিছু যেন করে দেখাবে আজ। একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, ‘দুপুরে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি ফিস। রাতে তন্দুরি, রুটি, সঙ্গে চিকেন কষা।’
হাঁ করে অমলেন্দু’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কাবেরী। বলে কী লোকটা! ওকে চুপ করে থাকতে দেখে অমলেন্দু আবার বলল, “তুমি বরং ড্রয়িংরুমে বসে আরাম করে টিভি সিরিয়াল দ্যাখো। কাটাকুটিও আমি নিজের হাতেই করে নেব। আজকে রান্নার ব্যাপারে এক পার্সেন্ট ক্রেডিট কাউকে আমি দিতে রাজি নই।
সত্যি কথা বলতে এসব কথা যখন কোনও স্বামী বিয়ের এতগুলো বছর পর বউকে বলে, তার খুশি হওয়ার কথা। কাবেরীর মনে হচ্ছে, আজ অমলেন্দু আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে আছে। শরীরে আপনা থেকেই একটা যেন আলিস্যিভাব চলে আসছে। গলায় অবিশ্বাস ফুটিয়ে বলল, “ঠিক তুমি ম্যানেজ করে নিতে পারবে?”
—শুধু দেখতে থাকো।
অমলেন্দু চায়ের খালি কাপ ডিশ, ট্রে-তে নিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কাবেরী বাথরুমে ঢোকে।
ম্যাক্সি পরে, অল্প ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে বেডরুমে চলে এল কাবেরী। এ রকম বেলার দিকে গা এলিয়ে অনেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকা হয়নি। অমলেন্দু সাড়ে ন’টার মধ্যেই বেরিয়ে যায় অফিস থাকলে। বেরনোর আগে পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একেকদিন একেকটা এপিসোড করে লোকটা। কোনওদিন রুমালের বদলে পকেটে এক পার্টি মোজা ঢুকিয়ে খুঁজতে থাকে, কোনওদিন মোবাইল রেখে আসে কমোডের ফ্ল্যাশ বক্সের উপর। মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে কাবেরী ভেবেছে, এই মানুষটাই কোন জাদু বলে নিজের অফিসে এত ভালো পারফরম্যান্স লেভেল বজায় রেখেছে। লকডাউন হয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য এখন সেসব দক্ষযজ্ঞের হাত থেকে মুক্তি।
ক্রমশ…