কাবেরী জানে, জামাইয়ের ব্যাপারে নিজের মায়ের একটা অদ্ভুত আদিখ্যেতা আছে। কিছু কিছু ব্যাপারে তো ওকেই রীতিমতো ধমকে চুপ করিয়ে অমলেন্দুর পক্ষ নেয়। বাবা বরং বেশ নিরপেক্ষ। কথা ঘুরিয়ে কায়দা করে অন্য বিষয়ে চলে গেল।

অন্যদিন এ সময় মা ফোন করলে তাড়াহুড়ো করে। আজ ধীরেসুস্থে কথা বলতে বলতে যে অনেকটা সময় চলে গেছে খেয়াল ছিল না। খেয়াল হল যখন উঁকি মেরে অমলেন্দু ইশারায় খেতে ডাকল। ফোন রেখে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। শুকনো মুখে টেবিলে খাবারের বোলগুলো রাখল অমলেন্দু।

বোলের ঢাকনা খুলে চক্ষু চড়কগাছ কাবেরীর। ভেটকির ফিলে ভেঙে লটে মাছের ঘ্যাঁটে পরিণত হয়েছে। ফ্রায়েড রাইস হয়ে গেছে ফ্যানে ভাত।

—এটা কী হয়েছে, গলা আপনা থেকেই চড়ে গেল কাবেরীর।

গণ্ডগোলটা কোথায়, নিজেও জানে অমলেন্দু। ড্যামেজ কনট্রোল করার ভঙ্গিমায় বলল, ‘আসলে ভেটকিগুলো একটু শক্ত ছিল তো। একটু বেশিক্ষণ ধরে কষতেই বলা ছিল প্রিপারেশন গাইডলাইনে, তারপর এক সেকেন্ড থেমে বলল, তারপর ওই অফিসের তরফদারদা ফোন করল…।’

তিন্নি ইতিমধ্যেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ডিশের ছবিগুলো তোলার জন্য মোবাইল ফোকাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ক্যামেরা গুটিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

কোনওক্রমে খাবার গলা দিয়ে নামাল কাবেরী। মাথা নীচু করে এক মনে খেয়ে যাচ্ছে তিন্নি। খেয়ে একটা বড়ো ঢেঁকুর তুলল অমলেন্দু, “রাতের প্রিপারেশনের সময় তিন্নি ইউটিউবের চ্যানেলটা সামনে একটু খুলে ধরে থাকিস তো।”

কাবেরী একটা হেঁচকি তুলে কাতর মিনতি করল, “আর না। দোহাই আর না। আমার বিশ্রামের আর দরকার নেই। ও বেলারটা আমিই করে নেব। তুমি আর রান্নাঘরে এসে আমার উপকার কোরো না।”

চোখে কাতর অনুরোধ ফুটিয়ে অমলেন্দু বলল, “প্লিজ। ওয়ান লাস্ট চান্স। কথা দিচ্ছি, আর কোনও গণ্ডগোল হবে না। তিন্নি তুই এবার আমার সঙ্গে থাকবি।”

কাবেরী চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাপ-মেয়ে মিলে যা খুশি করো। কমিউনিটির পুজো মিটিং আছে আজ মহিলাদের। আমি চললাম।”

কোভিড পরিস্থিতিতে কমিউনিটি হলে মেম্বাররা দূরত্ব রেখে বসেছে। মুখে মাস্ক। প্রফেসর অর্ণব সান্যালের বউ শকুন্তলা সান্যাল হলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে স্প্রে করে হ্যান্ড স্যানিটাইজ করাচ্ছেন। কাবেরীদের ফ্ল্যাটের উপর তলাতেই থাকেন।

কাবেরী ঢুকে বুঝতে পারল, সব মেম্বার বা বেশি বয়স্কদের ডাকা হয়নি। প্রত্যেক বছরেই এই মিটিংটা হয়। মূলত আলোচনার বিষয় থাকে, পুজোর চারদিন জোগাড় আর ভোগরান্না কোনবেলায় কারা করবে। সব বছর এক থাকে না লিস্টটা। কারণ কিছু ফ্যামিলি এক আধ বছর বেড়াতে যায়। ফলে প্রত্যেক বছরই মিটিং-এ আলোচনা করে ঠিক করা হয়, দায়িত্বে ঠিক কারা থাকতে পারে। ঘুরতে যাবার প্ল্যানিং এখন সবাই পুজোর অনেক আগে থেকে করে। তাই আলোচনাটা সহজ হয়ে যায় অনেক। এ বছর অবশ্য একটা গোলমেলে পরিস্থিতি। পুজো হবে, সিদ্ধান্ত নেবার পরে এই মিটিং-এর আয়োজন।

মিটিং শেষ করে, ইচ্ছে করে একটু দেরি করে ফিরল কাবেরী। ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা।

ফ্ল্যাট জুড়ে সুন্দর কষা মাংসের গন্ধ ভাসছে। খাবার টেবিল খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে বাবা-মেয়ে। খিদে পাচ্ছিল।

মুখ-হাত ধুয়ে ন’টা নাগাদ খেতে বসল ওরা তিনজন। অমলেন্দুর মুখে একটা লাজুক হাসি। রান্নাঘর দর্শন করে এসেছে। ঝকঝক তকতক করছে। রুটি আর মাংস প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে অমলেন্দু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবটা, কী, কেমন দিলাম!

রুটি-মাংস মুখে দিয়ে কাবেরীর মন ভালো হয়ে গেল। কথা রেখেছে অমলেন্দু। সত্যিই লা-জবাব স্বাদ হয়েছে। গলা দিয়ে নামাতে নামাতে কাবেরী শুধু বলল, ‘এ তো স্বর্গীয় বানিয়েছ গো।’

লজ্জায় মাথা নামিয়ে অমলেন্দু কমপ্লিমেন্টটা নিল। তিন্নি কাবেরীর মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে ফেরাল। বাবা-মেয়ের মুখে বিজয়ীর হাসি। ওর নিজেরও মনে হচ্ছিল, সব ভালো যার শেষ ভালো। শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছে অমলেন্দু। সত্যিই করে দেখাল। সকাল থেকে বিপর্যয় ঘটলেও এক মুহূর্তের জন্যও হাল ছাড়েনি।

তিন্নি ঘরে চলে গেছে নিজের। শুতেই যাচ্ছিল কাবেরী। উপরের তলার মিসেস সান্যাল ফোন করলেন, ‘কী কাবেরী, আজ মিটিং-এ বললে তোমার হাজব্যান্ড রান্না করছে, এ দিকে মিটিং থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসার সময় দেখলাম, তোমার ফ্ল্যাটে অনলাইন অ্যাপ থেকে খাবার ডেলিভারি হচ্ছে?’

কাবেরী তাকাল অমলেন্দু’র দিকে। সারাদিনের কাণ্ডকীর্তির পর ইতিমধ্যেই অঘোরে ঘুম শুরু করে দিয়েছে। মিসেস সান্যালকে বলল, ‘হ্যাঁ, ওর শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। তাই আর পারেনি করতে।’

ফোন নামিয়ে বিছানায় উঠে এল কাবেরী। আর ঠিক তখনই ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের আঁস্তাকুঁড়টায় কয়েকটা কুকুরের তর্জন-গর্জন আর লড়াই শুরু হল। মনে হল, যেন ফেলে দেওয়া খাবারের জন্যই সে লড়াই।

সমাপ্ত

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...