শেষ পর্ব

শ্রীর সঙ্গে প্রতি পদে পদে ঝগড়া ও আপস করে করে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন কাটতে থাকে বিতানের। শ্রীর জন্য দামি দামি শাড়ি, গয়না, দামি কসমেটিক, পারফিউমের জোগান দিতে দিতে কখনও কখনও তার পকেটের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। সমতা রক্ষা করতে পারে না অনেক সময়। সহ্য করতে না পেরে একদিন ফোন করে ফেলল শ্বশুরমশাইকে।

—নিজের লুকস আর আমাকে ঘিরে শ্রীর অবসেশন যে রোগের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্লিজ কিছু করুন, বাবা।

—না না, বাবা। মা মরা মেয়ে তো। আদরে আদরে মানুষ। একটু জেদি হয়ে গেছে। তুমি ওকে একটু সামলে রেখো। চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।

ফোনের ও প্রান্তে কাঁদতে থাকেন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ। মুখে আর কোনও কথা সরে না বিতানের। বাড়িতে মাকে কিছু বললে মা-ও সেই একই কথা বলে, ‘ঠিক হয়ে যাবে।’ বন্ধু আবারও বলে, ‘এ যুগের মেয়ে। মানিয়ে নিতে হবে রে, ভাই। তোকে খুব ভালোবাসে। চোখে হারায়। ভালোই তো।’

ভালো আর কিছুতেই হয় না বিতানের জীবনে। এভাবেই চলতে থাকে প্রতিটা দিন। ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে সে। নিজেকে যেন শ্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। রাতে ঘুমের মধ্যেও শ্রীর এই ভয়ানক অবসেশন তাড়া করে ফেরে তাকে! নিজের জীবনটা যেন আঁজলা গলে বেরিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।

এই করতে করতে প্রথম বিবাহবার্ষিকী এগিয়ে আসে বিতান আর শ্রীদর্শিনীর। খুব ধুমধাম করে উদযাপন করবার পরিকল্পনা নেয় তারা। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করবার লিস্ট তৈরি হয়। কিন্তু লিস্ট দেখে প্রথমেই বাদ সাধে শ্রী, ‘তোমার মায়ের বান্ধবী রঞ্জনামাসিকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না। ওঁর মেয়ে রনিতা খুব সুন্দরী, না? তোমার সঙ্গে তো ওর বিয়ের কথা হয়েছিল, অ্যাম আই রাইট? পুরোনো প্রেম চাগাড় দিক আর কি! আর তোমার অফিসের ওই দুই সুন্দরী মৃদুলা আর সেবন্তীও বাদ কিন্তু…’

—শোনো না, আমার কিন্তু অ্যানিভার্সারির গিফটে হিরের দুল চাই। হঠাৎ একেবারে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে আদুরে গলায় বলে ওঠে শ্রী। প্রথম অ্যানিভার্সারিতে শ্রীকে সোনার কোনও গয়না দেবে ভেবে রেখেছিল বিতান। হিরের গয়নার কথা ঠিক ভাবেনি। এটা তার বাজেটের বাইরে।

রঞ্জনামাসিকে নিমন্ত্রণ লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ায় বিতান বোঝে মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বউমাকে খুশি করতে মুখ ফুটে মা কিছুই বলে না। বিতান শ্রীর মতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে সে না খেয়েদেয়ে কান্নাকাটি করে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। সেই রাতেই ব্লেড দিয়ে হাত কেটে সে ভয়ানক এক হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধাল। শেষপর্যন্ত শ্রীর সব কথাই তাদের মেনে নিতে বাধ্য হতে হল। ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচতে থাকে বিতান। মাঝে মাঝেই নিজেকে শেষ করে দেবার আগুনে-ইচ্ছে জেগে ওঠে তার মনে!

অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে শ্রীর আবদারে অফিস থেকে ছুটি নেয় বিতান। শপিং-এ যাবে সে। দুপুরের ঠিক আগে আগে দু’জনে বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্য শপিং করে বাইরে কোথাও লাঞ্চ সেরে একেবারে বাড়িতে ফিরবে। পাঁচতলা বিখ্যাত বস্ত্রবিপনি সংস্থায় ঢোকে তারা। দোকানের মালিক বিতানের বাবার আমল থেকে পরিচিত। সাদরে অভ্যর্থনা জানায় তাদের। নিজের আর বিতানের পোশাক পছন্দ করতে শুরু করে শ্রী।

নিজের জন্য তুলে নেয় মটকা সিল্কের হাত বাটিক, র’তসরের ব্লক প্রিন্ট, স্ট্রাইপড কাতান, বিষ্ণুপুরী সিল্কের ওপর অ্যাসিড পেইন্টেড শাড়ি। এ কাউন্টার থেকে ও কাউন্টারে ছুটোছুটি করে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিতে থাকে ব্যাঙ্গালোর সিল্কে কাঁথার কাজ, কোসাসিল্ক শাড়ি, কাঞ্জিভরম, ইক্কত, গাদোয়াল, নয়েল সিল্ক-কুর্তি, পালাজো, লং স্কার্ট, আনারকলি স্টাইলের লং কামিজ ও চুড়িদার কিছুই বাদ যায় না! তারপর নিতে থাকে বিতানের পাঞ্জাবি, জিন্স, শার্ট, শ্রী যেন হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। মুখে তার লেগে আছে অলৌকিক এক টুকরো হাসি। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একতলা থেকে পাঁচতলা গোটা দোকানময় ছুটে বেড়াচ্ছে সে। খিদে তৃষ্ণাও ভুলে গেছে যেন!

—মুর্শিদাবাদি সিল্কে বাঁধনি আর অজরখ প্রিন্টের কম্বিনেশনের এই শাড়িটা নিই, বিতান? দু’ধরনের প্রিন্টে একটা এক্সক্লুসিভ মাত্রা পেয়েছে শাড়িটা, দ্যাখো দ্যাখো! বিতানকে শাড়িটা দেখিয়ে আদুরে গলায় বলে ওঠে শ্রী। তার উজ্জ্বল চকচকে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় বিতান।

—আর বাঁদিকে কোণের ওই শাড়িটা দ্যাখো! অলিভ গ্রিন বাফতা সিল্কের উপর কলমকারি প্রিন্টে স্মার্ট লুক! শাড়িতে এইসব প্রিন্টের বৈচিত্র এখন ট্রেন্ডিং, জানো? এ শাড়িটাও নিয়ে নেব? ঘামতে থাকে বিতান। দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার।

—আমি একটু বাইরে থেকে আসছি শ্রী। তুমি কেনাকাটা করো…

সন্ধে হয়ে এসেছে। সময় যেন উড়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে গোটা দোকানের আনাচকানাচে। হঠাৎ তার বাবার ফোনে হুঁশ ফেরে শ্রীদর্শিনীর।

—শিগগির বাড়িতে এসো। এক্ষুনি। রাইট নাও।

বাড়ি ফিরে শ্রী জানতে পারে একে একে প্রতিটি ধাপ। বিতান কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ি এসে সোজা ঢুকে গিয়েছিল নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিলেও জানালা দিয়ে বিতানকে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন তার মা। চিৎকার করে পড়শিদের ডাকেন তিনি। তারা এসে দরজা ভেঙে বিতানের দেহ নামিয়েছে। সবটা শোনার পর কেমন হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শ্রী। যেন বুঝতেই পারে না কোথায় বাঁধল গোলমালটা! বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে।

পুলিশ আসে অনেক রাতে। আর শ্রীকে তখনও দেখা যায় বারান্দার এক কোণে জামাকাপড়ের প্যাকেটগুলো খুব শক্ত করে বুকে জাপটে ধরে মুখ নামিয়ে বসে আছে।

দিন সাতেক পরে শ্রীর বাবা তাঁর সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু ডা. বসুর চেম্বারে যান শ্রীকে নিয়ে। সমস্তটা শুনে ডাক্তারবাবু বলেন, ‘সময়মতো প্রপার মেডিকেশন আর সাইকোথেরাপি শ্রীদর্শিনীকে তার সুস্থ জীবন যাপনে ফিরিয়ে দিতে পারত। সেটা তো গেল শ্রীর কথা। উলটো দিকে শ্রীর অস্বাভাবিকতার জন্য একটা তাজা তরুণ প্রাণ এভাবে অকালে যে চলে গেল, সেটাও হয়তো আটকানো যেত। আগে কেন গুরুত্ব দিলে না, বন্ধু!’

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...