সার্থক আর অনন্যার সম্পর্কের কথা অফিসে কারওরই অজানা ছিল না এবং সকলেই চাইত ওরা দু’জনে বিয়ে করে নিক। ওদের দু’জনেরই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমাণ করত দু’জনের মধ্যের ভালোবাসাটা কতটা গভীর।

—সার্থক, কবে বিয়ে করছ অনন্যাকে? অফিসের সহকর্মী আশিস অফিস ফাঁকা দেখে সার্থককে জিজ্ঞাসা করল। সার্থক আর আশিসের বন্ধুত্ব প্রায় নয়-দশ বছর গড়াতে চলল। অফিসেরই এক কলিগের মেয়ের বিয়েতে গেছে অফিসের বেশির ভাগ লোকজন। অফিস মোটামুটি ফাঁকা দেখেই আশিস প্রশ্নটা করেছিল।

অনন্যা বেরোবার সময় নিজের পার্সটা নিতে ভুলে গিয়েছিল, সেটাই নিতে অফিসে ফিরে এসেছিল। না চাইতেও আশিস আর সার্থকের কথোপকথন ওর কানে গেল। আশিসের মুখে নিজের নাম শুনে কৌতূহলবশত অনন্যা দাঁড়িয়ে গেল।

—অনন্যাকে আমি পছন্দ করি আশিস, ও খুব ভালো মেয়ে। কুশলও ওকে ভালোবাসে। কিন্তু অনন্যা এখন কুশলকে পছন্দ করলেও যখন ওর নিজের সন্তান হবে তখন কুশলকে ওর ভালো না-ও লাগতে পারে। আমি আমার ছেলের জন্য জীবনে কোনওরকম রিস্ক নিতে রাজি নই। আশিসের প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেয় সার্থক৷

এই কথা শোনার পর অনন্যার আর দাঁড়িয়ে কিছু শোনার ক্ষমতা ছিল না। পার্সটা নিয়ে অফিস থেকে ও বেরিয়ে গেল।

তিন-চারদিন অনন্যা অফিস এল না। মোবাইলও বন্ধ ছিল ওর। সার্থক কোনওরকম খবর না পেয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল। দুই বছরে এই প্রথমবার অনন্যার অনুপস্থিতি ওকে ভিতরে ভিতরে চিন্তায় পাগল করে তুলল। ও বুঝতে পারছিল না কী করে অনন্যাকে ছাড়া ওর জীবন চলবে? অফিসের প্রত্যেকে, সার্থকের এই মানসিক অস্থিরতা উপলব্ধি করতে পারছিল এবং বুঝতেও পারছিল ওর ব্যবহারে এই অসংলগ্নতার কারণ।

পাঁচদিন কেটে যাওয়ার পর সন্ধের দিকে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল সার্থকের বাড়ির সামনে। ট্যাক্সি থেকে নেমে অনন্যা সার্থকের দরজায় কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে অনন্যাকে সামনে দেখে সার্থক হতবাক হয়ে গেল।

অনন্যাকে খুব দুর্বল লাগছিল দেখতে। দেখে মনে হচ্ছিল কোনও শক্ত অসুখ থেকে সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তা চেপে রেখেই সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার অনন্যা, পাঁচদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

ততক্ষণে কুশলও এসে দাঁড়িয়েছে অনন্যার কোল ঘেঁসে। ব্যাগের থেকে দুটো চকোলেট বার করে কুশলের হাতে দিল অনন্যা। সস্নেহে ওর নরম গালে হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলের মধ্যে ঠোঁট ঠেকাল অনন্যা।

প্রতিবারের মতোই ‘থ্যাংক ইউ’ বলে কুশল অনন্যার কোলে মুখ লুকাল।

—কী হল অনন্যা, বললে না তো তোমার কী হয়েছে। পাঁচদিন কোথায় ছিলে? অনন্যার উত্তরের অপেক্ষায় অধীর হয়ে উঠছিল সার্থক।

অনন্যা একটা গভীর নিশ্বাস নিল। হাতের ফাইলটা থেকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল সার্থকের হাতে।

—এটা কী? সার্থক চোখ রাখল কাগজটিতে। বিস্ময়ে এবং হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কাগজটির দিকে। অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোল সার্থকের মুখ দিয়ে, ‘অনন্যা এটা তুমি কী করেছ?”

অনন্যাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সার্থক বলে উঠল, “তুমি নিজেকে এভাবে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করলে? কেন তুমি নিজের অপারেশন করালে?’ হাতের মেডিকেল সার্টিফিকেটটা নিয়ে সার্থক পাথরের মতো বসে রইল। এবার অনন্যা মুখ খুলল।

—সার্থক তুমি আমাকে বিয়ে করতে এই জন্যই রাজি ছিলে না বা ভয় পাচ্ছিলে যে, আমাদের সন্তান হলে আমি কুশলকে আর ভালোবাসব না। ওর খেয়াল রাখা বন্ধ করে দেব। এই ভাবনাই তোমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি যে, কুশলই আমার একমাত্র সন্তান হয়ে থাকুক। তাই ভবিষ্যতে যাতে কোনওদিন নিজে মা হতে না পারি সেজন্য সকলের আশঙ্কাই শেষ করে দিতে আমি নিজের অপারেশন করালাম। সার্থক আমি তোমাকে কোনওভাবে হারাতে চাই না। অনন্যার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

—অনন্যা, আমাদের সকলের জন্য তুমি এই নিয়ে তিন তিনবার চরম স্যাক্রিফাইস করলে। তোমার হৃদয়ের এই বিশালতার কাছে আমার কিছু বলা অতি তুচ্ছ! আমি তোমাকে দেখে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি, বলে সার্থক অনন্যাকে নিজের বুকে টেনে নিল। অনন্যা অবাক হয়ে দেখল সার্থকের দু’গাল বেয়ে নামছে অশ্রুধারা!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...