এদের কথাবার্তার মাঝে ওদের মা সুভাষিণী এক সময় এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নারে, সরমা তেমন মেয়ে নয়। হয়তো কোনও অসুবিধায় পড়েছে। আটকে গেছে কোনও কারণে।’

‘তুমি এখন ঘরে যাও মা। আমরা মরছি নিজেদের জ্বালায়, তোমার আর কী? বেশ তো আছ নিজের নিয়ে।’

‘দেখ বড়োখোকা, একদিন এই আমিই তো সারা সংসারটা টেনেছি। তোদের সকলকে মানুষ করেছি। তারপর আসা-যাওয়া তো নিত্যদিন। সব তো একা এক হাতেই সামলেছি।’ ‘এই শুরু হল’, বলে মেজোবউ। তা আপনিও তো একটা দিন করে দিতে পারেন মা। আমাদেরও তো ইচ্ছে হয় আপনার হাতের রান্না খেতে। আমরা এদিকটা তাহলে সেরে নিতে পারি।’

‘হ্যাঁ মা, তুমি ব্যবস্থা করো যা হোক করে। অনেকদিন তোমার হাতের রান্না খাইনি।’ বলে ছোটোছেলে সমু।

সবার অনুরোধে আজ সুভাষিণী রান্না করবেন ঠিক হয়েছে। অনেক-অনেকদিন তিনি এ ঘরে ঢোকেননি। সে প্রায় বছর দশ আগের কথা। সবে কর্তা দেহ রেখেছেন। ছেলেদের বিয়ে থা হয়ে গেছে। মেয়েরা সব শ্বশুরবাড়ি করছে। পিঠের দিকে হঠাৎ একটা সাদা দাগ দেখা গেল সুভাষিণীর। বড়োবউমা সেটা আবিষ্কার করলে। সারা বাড়িতে হইহই পড়ে গেল। ভাগ্যিস মেয়েদের বিয়ে থা হয়ে গেছে। নয়তো কী হতো, অস্থির সুভাষিণীর বউমা।

ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এল। তিনি সব দেখে বললেন, এটি কুষ্ঠ কিংবা শ্বেতি নাও হতে পারে। উনি নিশ্চয়ই কোনও এক সময় অসুস্থতার জন্য প্রচুর ওষুধ খেয়ে থাকবেন। তার বিষক্রিয়াও হতে পারে। তা যাই হোক, ধৈর্য ধরে ওষুধ খেতে হবে ওনাকে।

মন থেকে তবু ওদের শঙ্কা গেল না। ভরা সুখের সময় সুভাষিণী নির্বাসিতা হলেন নীচের তলার একটি কোণের ঘরে, যার পাশে ঠাকুরঘর। ছেলেরা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ‘আমরা সবাই উপরে থাকব আর মা একা কী করে নীচে থাকবে? রোগ অসুখ কার না হয়। আজ যদি আমাদের কারও হয়?’ কিন্তু ওদের হার মানতে হয়েছে সহধর্মিণীদের কাছে।

সুভাষিণীর অনুগত বউমারা ধীরে ধীরে দুর্বিনীতা হয়ে গেল। নাতি-নাতনিগুলি যেগুলি ছিল ওদের ঠাকুমার প্রাণস্বরূপ, তাদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হল না সেদিন থেকে। আদরের নাতি-নাতনিদের না দেখে মরায় বাঁচায় হয়ে রইলেন তিনি। জানালার রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন কখন ওরা স্কুল যাবে। কখন ওদের দেখতে পাবেন এই আশায় ৷ তারপর রোগ সেরে গেছে একদিন। দাগ মুছে গেছে। কিন্তু মন থেকে দাগ মুছতে পারেনি সুভাষিণীর পুত্রবধূরা। সুভাষিণীও কতকটা অভিমানবশত স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন। নিজেই রান্না করে খান। ছেলেরা খোঁজখবর নেয়। রান্নার মেয়ে সরমা বাজারহাট যা লাগে এনে দেয় সময়মতো। একা বিধবা মানুষের আর কতই বা লাগে । আজ একাদশী। একথা এদের কারও জানার কথা নয়। এক সরমা থাকলে সেই এনে দিত ফলমিষ্টি। তা যাই হোক এবেলা তিনি কিছু খাবেনও না।

গ্যাসে একটি বড়ো হাঁড়ি বসিয়েছেন সুভাষিণী। অনেকদিনের পর আজ সবার অনুরোধে তিনি রান্নাঘরে ঢুকেছেন। অথচ এই রান্নাঘরে তাঁর দিনের বারো আনা সময় কেটে যেত। নিজের হাতে মশলা বাটা, কুটনো কাটা সবই। ছ-ছটি ছেলেমেয়ে, কর্তা নিজে। তারপর তো দেওর, ননদ, ভাগনে, ভাগনি লেগেই থাকত বাড়িতে। রান্নাঘরের কোথায় কী আছে এখন আর তিনি কিছুই জানেন না। নাতনি সংগীতা এসেছে ঠাকুমাকে সাহায্য করার জন্য। আজ অনেকদিন পরে ওকে দেখলেন সুভাষিণী একেবারে কাছের থেকে। চমৎকার দেখতে হয়েছে তাঁর বড়ো নাতনিটি। এখন কলেজে পড়ে। এই নাতনিটির ঠাকুমার কাছে ছাড়া ঘুম হতো না একসময়।

(ক্রমশঃ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...