মণি ঘোষাল। ইন্টেলেকচুয়াল। ছুঁচলো তার দাড়ি, অনেকটা আব্দুল মাঝির মতন। চোখে রিমলেস। ষাটোর্দ্ধ। টানটান আপাদমস্তক। ঠোঁট সতত একটা আলগা হাসির ক্লান্তিতে ঝুলন্ত। লম্বা চুলের মাথা সাহিত্যে খচাখচ। পায়ে কোলাপুরি। কাঁধে পত্রিকা ঠাঁসা শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ। নীল জিনস-এর সাথে সাদা পাঞ্জাবি। সেই কোন বছর চল্লিশ আগে পথ চলা শুরু।

মণি তখন বছর কুড়ির উঠতি কবি সাহিত্যিক। দু’চারজন ঘনিষ্ঠকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করল— ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। তখন তো তার বিশ্বজয়ের আনন্দ। দু’টো ছোটোগল্প আর খান চল্লিশেক কবিতার প্রশ্রয়কে সঙ্গী করে তার সদর্প আবির্ভাব আসানসোলের সাহিত্যজগৎকে আলোকময় করে তুলল।

তারপর তো দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দশক কেটে গেছে। মণি ঘোষালের সোসিও—ইকনমিক ফান্ডাও নাকি বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ শক্তিশালী! কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল পত্রিকা প্রকাশের সাথে সাথে বই প্রকাশনাটাও একান্ত জরুরি। পত্রিকা কুনকি হাতির কাজ করবে— যাতে করে বই প্রকাশনাটাও নিয়মিত থাকে৷ এইভাবেই মণি মূলত অর্থকরী দিকটা সামাল দেয়।

পত্রিকা নতুন নতুন কাব্য প্রতিভার সন্ধানের একটা ইন্সট্রুমেন্ট আর তারপর কিছু সময় অপেক্ষা এবং একদিন ঝপাং করে বই প্রকাশনার যাঁতাকলে পড়ে ছটপটাবে বেচারা কবি সাহিত্যিক কমপক্ষে হাজার পনেরোর ধাক্কায়! আর পায় কে? মণি তার মলাট উন্মোচনের জন্য পকেট কাটবে, তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পকেট কাটবে। পুশসেলের সব পয়সাই যে মণির পকেটস্থ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। নামডাকে মণি কিন্তু বেশ তুখোড় পরিচিতির নিরিখে। নিন্দুকেরা সময় সময় তার সম্পর্কে মন্দভালো কিছু না কিছু বলেই থাকে। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। সে নাকি আদ্যোপান্ত নিবেদিত সুমহান এক সাহিত্য প্রাণ। অক্ষরকর্মী শব্দকর্মী এরকম নানা বিশেষণেই নাকি তার ঝুলি বিভূষিত।

লোকে পিছনে তাকে ‘মাল ঘোষাল’ বললে কী হবে, সামনে তো গদগদ ভাব দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হে হে… করতে থাকে! মণি এটাও জানে লোকে ঈর্ষা থেকেই এইসব অপপ্রচার করে থাকে। যাইহোক, নেগেটিভ হলেও প্রচার তো একটা বটেই। লাদেনের নাম কে না জানে— সে যে- জন্যই হোক! জানে কি না? একশোবার হাজারবার অস্বীকার করে সাধ্যি কার? মণি তার প্রবল অস্তিত্বটার গোড়ায় নিয়মিত জল সার দিতে ভুল করে না কখনও। মাসে দু’তিনটে গল্প আলোচনা কবিতা পাঠের আসর জমাবেই জমাবে। দশ পনেরো জন তো এমনি এমনিই জুটে যায়। অবশ্য তাদের অধিকাংশই একদা চাকুরিজীবী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সময় কাটাতে কবি সাহিত্যিক হতে গিয়ে মণির খপ্পরে।

কিংবা হয়তো একদা গৃহকর্মে নিপুণা এখন প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কবি কিংবা গল্পকার হয়ে ওঠার বাসনায় মণির ভেল্কিবাজি ধরতে না পেরে গল্পপাঠের আসরে দিস্তাখানেক কাগজ নিয়ে হাজির। মাঝবয়সিরা থাকে না এমন নয় তবে সংখ্যারলঘু পর্যায়ের। আর অবশ্যই অকর্মণ্য কিছু গ্র্যাজুয়েট, বাপের হোটেলে খেয়ে সাহিত্যের খোলনলচে পালটে তাকে উত্তর আধুনিকের পথ দেখানোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিছু দামড়া ছেলে। লিটল ম্যাগের মাহাত্ম্যে তার বিপ্লবী ইমেজ সম্পর্কে মাইক হাতে টানটান বক্তিমের জোরে হল ফাটানো হাততালি। ওরে বাপরে! শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শুধু নয়, সেই কাঁটা আবার ফুটেও যায়। সাথে মণির উস্কানির উত্তেজনা কামাল করে দেয় তাদের।

আঃ ভাবা যায়— ছোটোগল্পের কী দুর্দান্ত আলোচনাটাই না করলি রে অমরেশ। আর বোঝাতে গিয়ে তোর নিজের লেখা যে গল্পটা পড়ে শোনালি— তার জন্য কোনও তারিফই যথেষ্ট নয় রে! আয় আয় আমার বুকে আয়। একটা হামি দিইরে তোকে। আমার চাঁদের ছেলে আমার সোনার ছেলে। তারপরই গলাটা একপর্দা খাদে নামিয়ে বলে— বিমল করের মতো লেখকও তোর মতন এমন একটা লিখতে পারলে ধন্য হয়ে যেত রে। অমরেশ বিনয়ে মাটিতে মিশে যেতে বসেছে আর ভিতরে ভিতরে ফুলে ফেঁপে ঢোল— যে-কোনও সময় বিস্ফোরণের দিকে চলে যেতে পারে আপ খেতে খেতে। অমরেশ কিন্তু ফাটল না, যেহেতু আনকোরা নতুন নয়। তবে ফুলেফেঁপে থাকবেই এখন দিনকয়েক।

এবারের শারদসংখ্যায় তনু নাগরাজের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেছে মণি। তনু নাগরাজ বাড়িতে প্রায় সারাদিন একা। ছেলে বাইরে। বর একটা কোম্পানির ম্যানেজার। রান্নার লোক কাজের লোক বাগানের মালি ঠাকুর চাকর— কী নেই তার। নিজহাতে তাকে কুটোটি কেটে দু’টো করতে হয় না। বয়কাট চুল, তাও আবার আঁচড়ে দেওয়ার জন্য একটি মেয়ে আসে, তার পার্লারে যাওয়ার আগে ম্যামকে সাইজ করে দিয়ে যায়। তারপর সে তার লেডিস পার্লারের দোকান খোলে। আর সাহিত্যসভাতে গেলে তার তো আবার বিশেষ প্রস্তুতি থাকে, সেদিন সে মেয়ে তনু ম্যাডামকে একেবারে চিকনাই করে ছেড়ে দেয় ঘণ্টা দুয়েকের পরিচর্যায়।

মণির আদরের তনু কবিতাগুচ্ছ পাঠ করে শোনাল। মুগ্ধ হলঘর করতালি মুখরিত। মণি এবার তনুর একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবছে। পাঁচ ফর্মার করার প্ল্যান আছে। সত্তর বাহাত্তরটা কবিতা হলেই হবে। তা তনুর সংগ্রহে এখন ষাটটার মতন আছে। বলেছে সপ্তাহ দু’য়েক সময় পেলেই নাকি নামিয়ে ফেলবে। মণির আদেশ লেখা শেষ হলেই যেন তনু তাকে ফোন করে। কোনও কালক্ষেপ না, সাথে সাথেই ডিটিপি-র জন্য চলে যাবে যথাস্থানে।

মণি খরচখরচা বাবদ দু’টো ইনস্টলমেন্টে পঁচিশ পঁচিশ করে মোট পঞ্চাশ দিতে বলেছে। বাকিটা নাকি মণি বুঝে নেবে। নীচে কোথাও কোনও ফুটনোট নেই, কোনও শর্তাবলী নেই, এমনকী নেই কোনও হিডেন কস্ট-ও। ফার্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল যাকে বলে। হাতি কা দাঁত মরদ কা বাত। এই হচ্ছে মণি ঘোষাল।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...