সেই রবিবার ফোনে তুষার বাবাকে জানিয়ে রেখেছিল, বিকেলে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সন্ধে থেকে রাত্তির, তবু দু’জনের দেখা নেই। কোনও ফোনও নেই। খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এগারোটা বাজতে যায় দেখে পরিমলবাবু স্ত্রীকে বললেন, ‘আর বসে থেকে লাভ নেই, চলো আমরা দু’জন খেয়ে নিই। মনে হচ্ছে ওরা অন্য কোথাও হয়তো গেছে।’

অসীমাদেবীর চোখ জলে ভরে আসে, ‘হ্যাঁ গো, ওরা কি আমাদের কথা চিন্তাই করে না? রঞ্জনা না হয় পরের বাড়ির মেয়ে কিন্তু তুষার তো নিজের পেটের ছেলে। বাড়ি ছেড়ে তো আগেই গিয়েছে এখন এক-দুই ঘণ্টার জন্যে একবার চোখের দেখা দেখতে আসাটাও বন্ধ করে দিতে চাইছে। তুমি নিজে একবার ফোন করেও তো দেখতে পারো।’

পরিমলও প্রচণ্ড চিন্তা করছিলেন। একটু চড়া গলাতেই উত্তর করলেন, ‘তুমি কী ভাবো আমাকে? এতক্ষণ চুপচাপ বসে আছি? কখন থেকে সমানে চেষ্টা করছি। ফোন সুইচ অফ আসছে।’

‘তোমাদের কতবার বলেছি বাড়িতে ল্যান্ডলাইন ফোন করতে কিন্তু কেউই তোমরা শোনবার লোক নও। এই এমারজেন্সিতে…

রাতটা উৎকণ্ঠায় কোনওরকমে কাটিয়ে পরের দিন সকাল এগারোটাতে পরিমলবাবু, তুষারের অফিসে ফোন করলেন। ওখানে জানতে পারলেন স্ত্রীয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে তুষার ছুটি নিয়েছে। অসীমাদেবীও বউমার অসুস্থতার খবরে বিচলিত হলেন। সামান্য রান্না করে স্বামীকে খাইয়ে তিনজনের খাবার টিফিনবক্সে ভরে তৈরি হয়ে নিলেন ছেলের কাছে যাবার জন্যে। ব্যস্ততার কারণে পরিমলবাবু যেতে না পারলেও ট্যাক্সি ডেকে স্ত্রীকে তুলে দিলেন এবং ড্রাইভারকে তুষারের ঠিকানা দিয়ে ভালো করে রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন।

ড্রাইভার অসীমাদেবীকে তুষারের ফ্ল্যাটের নীচে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া গুনে নিয়ে চলে গেল। দোতলায় তুষারের নাম লেখা ফ্ল্যাটের দরজায় অসীমাদেবী কলিংবেল বাজাতেই তুষার এসে দরজা খুলে মা- কে দেখে অবাক হল, ‘একী, মা তুমি!’

‘ভেতরে তো আসতে দে। বউমার শরীর খারাপ শুনলাম। ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিস? এখন কেমন আছে? যা দূরে ফ্ল্যাট নিয়েছিস!’

ফ্ল্যাটে ঢুকেই অসীমার অভিজ্ঞ চোখে অনভিজ্ঞ সংসারের দুর্দশাগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়ানো, রান্নাঘরে এঁটো বাসন জড়ো করা। তিনদিন ধরে কাজের মেয়েটির অনুপস্থিতিতে বাড়ি যেন নরককুণ্ড। আর গৃহকর্ত্রী দু’দিন ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড জ্বর আর পেটে ব্যথা। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে অসীমাদেবা তুষারকে বললেন, ‘আমাকে একটা ফোন করতেও তো পারতিস। এরকম অসময়েই অপরের সাহায্যের দরকার পড়ে।

তুষারের হাজার মানা করা সত্ত্বেও অসীমা এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘরে সাজিয়ে রেখে সারা বাড়ি পরিষ্কার করলেন। কাচার জামাকাপড় একত্র করে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে তুষারকে ওটা চালিয়ে দিতে বললেন। রঞ্জনার জন্যে হালকা করে নিরামিষ ঝোল-ভাত বানিয়ে ওকে খাওয়ালেন। বাড়ি থেকে আনা খাবার নিজে এবং তুষারকে খেতে দিলেন। কাচা জামাকাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে রঞ্জনার কাছে বসলেন। রঞ্জনার মুখ থেকেই শুনলেন দু’দিন সে স্নান করেনি। তৎক্ষণাৎ জল গরম করে এনে ওর চুল ধুয়ে, হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে বাড়ির পোশাকটা বদলে দিয়ে ফ্রেশ নাইটি পরিয়ে দিলেন। বিকেল হয়ে এসেছিল। হঠাৎই রঞ্জনা অসীমার হাতটা চেপে ধরে বলল, মা আজ তুমি কোথাও যাবে না। রাত্তিরে আমার কাছে থাকবে, বাবাকে জানিয়ে দাও।’

“আমিও তাই ভাবছিলাম।’ রঞ্জনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অসীমা বললেন, ‘তোকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইছে না। তুষার, তুই বাবাকে ফোন কর। কাল উনি তোকে বহুবার ফোনে চেষ্টা করেছেন।’

‘মা, কাল রঞ্জনার বাড়াবাড়ি হওয়াতে আমি এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, ফোন করার কথা একদম মনে ছিল না। চার্জ শেষ হয়ে ফোনটা যে কখন অফ হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। বাবা নিশ্চই খুব চিন্তা করছেন। তার ওপর তুমিও যদি না পৌঁছোও…

“উনি চিন্তা করছেন ঠিকই কিন্তু আমি না গেলে ওনার অসুবিধা হবে না বরং বাইরের খাবার খেতে পারবেন। পরিবেশটা খানিক হালকা করার চেষ্টা করলেন অসীমা।

‘রঞ্জনা, এখন একটু স্যুপ খাবি?’

“মা, বাড়িতে তো কিছুই নেই। স্যুপ বানাবে কী দিয়ে?’ ‘তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব নিয়ে এসেছি।

রঞ্জনা ওনাকে থেকে যেতে বলেছে এটা অসীমার খুব ভালো লেগেছিল। প্রথম বাড়িতে ঢুকে রঞ্জনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। গৃহস্থ বাড়ি এত অগোছালো রাখতে আছে? চারিদিকে নোংরা, জামাকাপড়ের পাহাড় চেয়ারের ওপর জমানো। যে ছেলে নিজের বাড়িতে এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি সে কিনা এখানে এসে স্ত্রীয়ের সেবা করছে, রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু তুষারের মুখ চেয়ে অসীমা একটা কটু কথাও মুখে আনেননি। ছেলের সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোটাই তো মায়ের উচিত, এটাই মনে করে অসীমা চুপ করে থেকেছেন।

ক্রমশ…

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...