স্যমন্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ঘরের প্রতিটা জিনিস। বোঝার চেষ্টা করছিল ঠিক কোন গাঙে আজকাল তরী ভাসিয়েছেন মধুরিমা। একসময়ে খ্যাতির শীর্ষে থাকা গায়িকার এহেন স্বেচ্ছা নির্বাসন অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মঞ্চ সংগীতের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর হঠাৎই একদিন উবে গেলেন কপূরের মতো। মানুষের মন থেকেও আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকলেন মধুরিমা সরকার নামের সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিণী। তাঁর ফেলে যাওয়া আসন ভরাট করতে এগিয়ে এল একঝাঁক নতুন মুখ। এখনও কিছু রসিক শ্রোতার সংগ্রহ খুঁজলে মধুরিমার অনেক কালজয়ী গানের হদিশ পাওয়া যাবে।

মধুরিমা সরকারের নাগাল পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে স্যমন্তককেও। পুরোনো বাড়িতে ঢুঁ মেরেছে বার কতক। ফোন নম্বরও বদল হয়েছে। বহু চেষ্টার পর অবশেষে জানতে পেরেছে মধুরিমার বর্তমান ঠিকানার সন্ধান। ধরতে পেরেছে ফোনে। আর আজ বহুপ্রতীক্ষিত সেই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত। স্যমন্তকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল ক্রমশ। মনের ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল অস্থিরতা। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলেন। সাদা পোশাক পরিহিতা মধুরিমা। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল। মুখে আলতো বলিরেখার আভাস।

স্যমন্তকের দিকে প্রসন্ন মুখে চেয়ে বললেন, ‘কত বড়ো হয়ে গিয়েছ বুম্বা! বহু বছর বাদে তোমায় দেখলাম। ওম শান্তি!”

গভীর বিস্ময়ে স্যমন্তক দেখছে মধুরিমাকে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ছোটোমা!”

স্যমন্তকের বয়স যখন নয় কী দশ বছর তখন তার কাকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মধুরিমার। তাঁর গানের স্কুলের সবথেকে ভালো ছাত্রীটির প্রেমে পড়েছিলেন স্নেহাংশু। বিয়ে করেছিলেন সকলের অমতে বয়সে অনেক ছোটো মধুরিমাকে। স্নেহাংশুর বাড়ির লোকেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলেন সম্পর্কটা। কিন্তু বেঁকে বসলেন মধুরিমার পরিবারের লোকজন। বাপেরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল তাঁর।

প্রথম প্রথম সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। নতুন কাকিমার ভীষণ ন্যাওটা ছিল স্যমন্তক। ডাকত ছোটোমা বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল পরিস্থিতি। গানের জগতে মধুরিমার পরিচিতি বেড়ে যাচ্ছিল দিন কে দিন। অপরদিকে হীনম্মন্যতা গ্রাস করছিল স্নেহাংশুকে। গুরুর কাছে ছাত্রীর উন্নতি সুখের হলেও একজন স্বামীর কাছে তাঁর স্ত্রীর বাড়তে থাকা উচ্চতা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যত দিন এগোতে লাগল তত গরিমা বাড়তে লাগল মধুরিমার।

মুগ্ধ শ্রোতার দল ঘিরে থাকত তাঁকে। রেগে যেতেন স্নেহাংশু। ভেবেছিলেন সন্তান এলে হয়তো ভাটা পড়বে মধুরিমার সংগীত চর্চায়। কিন্তু দেখা গেল মিতিনের জন্মের পর দ্বিগুন উৎসাহে গান গাইছেন তিনি। একের পর এক আসছে কনসার্ট, সিনেমায় প্লে-ব্যাকের প্রস্তাব। ঈর্ষার বশে স্নেহাংশু বন্ধ করলেন গান শেখানো। ঝাঁপ পড়ল স্কুলের।

নেশার প্রতি আসক্ত হচ্ছিলেন স্নেহাংশু। মধুরিমার ওপর বাড়তে থাকা ক্রোধ তাঁকে ঠেলে দিচ্ছিল অন্ধকারের দিকে। সে সময় স্যমন্তক নেহাতই শিশু। অতশত বুঝত না কিছু। তবুও বেশ মনে পড়ে, প্রায় রোজ রাতেই ঝামেলা করতেন স্নেহাংশু। কিন্তু কোনও দিন সে তার প্রত্যুত্তরে রা কাড়তে শোনেনি মধুরিমাকে। নিত্য অশান্তিতে বিরক্ত হয়ে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মধুরিমা।

স্যমন্তকের মনে আছে সেই দিনটার কথা। তার ছোটোমার মাথায় আঘাত করেছিলেন কাকু। রক্ত ঝরছিল সেখান থেকে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন মধুরিমা। ছোট্ট মিতিনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্নেহাংশুর তীব্র বিরোধিতায় একরত্তি মেয়েটাকে না নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরিবারের সকলে হতভম্ব হয়ে দেখেছিল সব ঘটনা। মধুরিমা চলে যাবার মাস খানেক পর মিতিনকে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন স্নেহাংশুও। ছিঁড়ে যায় মধুরিমার সঙ্গে স্যমন্তকের যোগাযোগের শেষ সুতোটাও। আজ আঠারো বছর পর আবার মুখোমুখি বুম্বা আর তার ছোটোমা।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...