দিঘির জলের মতো স্থির, শান্ত চাহনিতে বাঁধা পড়েছে স্যমন্তক। বলার আছে অনেক কথাই কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে, ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বললেন মধুরিমাই, ‘আমার এ বাড়ির ঠিকানা তোমায় কে দিল বুম্বা?’

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে স্যমন্তক বলল, “আমি আপনার কলকাতার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম আপনি এখন আর সেখানে থাকেন না। বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়িটা। তারাই আমাকে কয়েকটা সম্ভাব্য ঠিকানার কথা বলেছিল। সবগুলোতে খুঁজে খুঁজে শেষমেশ জানতে পারলাম আপনি এখানে আছেন।’

—তা এত বছর পর হঠাৎ ছোটোমাকে এমন খোঁজাখুঁজি ? কোনও বিশেষ কারণ আছে নিশ্চয়ই? ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মধুরিমা।

সামন্তকের গলায় এখনও মৃদু উত্তেজনা, কারণ একটা আছে অবশ্য। কিন্তু বুম্বার কি তার ছোটোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? “বিশ্বাস করুন ছোটোমা, আমি বহুবার আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাকু নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন সব রাস্তা। তাই ইচ্ছে থাকলেও পৌঁছোতে পারিনি আপনাদের ধারে কাছে। যতদিন গায়িকা মধুরিমা সরকার প্রচারের আলোয় ছিলেন ততদিন তবুও আপনার খবরাখবর পেতাম। কিন্তু তারপর… ঠাকুমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপশোশ করে গিয়েছেন এই ছন্নছাড়া সংসারটার জন্যে। বাবা বরাবরই উদাসীন ছিল কাকুর প্রতি তাই ঠাকুমার হাজার বায়নাক্কার পরেও আগ বাড়িয়ে খোঁজ করতে যায়নি তাঁর। বারণ করে দিয়েছিল আমাকেও। কিন্তু সেদিন…..

—কেমন আছেন দাদামণি, দিদিভাই? স্যমন্তকের কথা মাঝ পথে থামিয়েই বলে উঠলেন মধুরিমা। —বাবা চলে গিয়েছে আজ দু’বছর হল। মা বাতের ব্যথায় কাবু। কোনওরকমে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

—আর তুমি? বিয়ে থা করেছ? কাজ কারবার?

—বিয়ে এখনও করিনি ছোটোমা। বাবার ওষুধের ব্যাবসাটারই হাল ধরার চেষ্টা করছি।

ভেতর ঘরে যাবার দরজাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আলতো হেসে উত্তর দিল স্যমন্তক। আর ঠিক তখনই নড়ে উঠল পর্দাটা। হাতে জলখাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল তন্দ্রা। টেবিলের ওপর রেখে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল মধুরিমার পাশে। বলল, “তুমি এখন চা খাবে মাসিমণি?”

—না রে বাবু, আজ আর চা খেতে মন চাইছে না। বুম্বা কে দে। তুইও খা।

—আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নেই ছোটোমা। এতসব আয়োজন না করলেই হতো।

—সে কী? এতবছর পর তোমাকে দেখছি দু’চারটে মিষ্টি খাওয়াব না? আপত্তি কোরো না। এই গরমে এতটা পথ এসেছ, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

খিদে তার জব্বরই পেয়েছিল তাই আর বেশি ভণিতা না করে দ্রুত তুলে নিল প্লেটটা। গোটা তিনেক মিষ্টি শেষ করে হাতে নিল বড়োসড়ো একটা শিঙাড়া। প্রসন্ন মুখে তার খাওয়া দেখছিলেন মধুরিমা। তন্দ্রা আড় চোখে নজর রাখছিল স্যমন্তকের ওপর।

—আর দুটো মিষ্টি দেবে?

—না না ছোটোমা, এই ঢের।

জল খেয়ে একটা মৃদু ঢেকুর তুলে জবাব দিল স্যমন্তক। খাওয়া দাওয়া সারা। এবার যত তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসা যায় ততই মঙ্গল। মধুরিমা বোধহয় পড়তে পেরেছিলেন স্যমন্তকের মনের কথাটা। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “তোমার এখানে আসার পেছনে কী একটা কারণ আছে বলছিলে…।’

—হ্যাঁ ছোটো মা, আসলে যে কথাটা বলছিলাম। এতগুলো বছর আপনার, কাকুর, মিতিনের কোনও খবর না পেয়ে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম সবকিছু। কিন্তু হঠাৎই দিন দশেক আগে কাকুর লেখা একটা চিঠি আসে ডাকে। জানতে পারি তিনি অসুস্থ। আমাকে তাঁর ঠিকানায় যেতে লিখেছেন। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলে স্যমন্তক, একবার দেখে নেয় মধুরিমাকে। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে আছেন সামন্তকের দিকে।

স্নেহাংশুর অসুস্থতার খবরে একটুও বিচলিত দেখাল না তাঁকে। রুমালটা পকেটে গুঁজে আবারও বলতে শুরু করে, অনেক খুঁজে পেতে অবশেষে উপস্থিত হই উত্তর কলকাতার এক ঘুপচি ঘরে। ওটাই কাকুর আস্তানা। হাঁপানির টানে দম নিতে পারছিলেন না তিনি। অনেক কষ্টে জানালেন আপনার কথা। বললেন, আপনাকে যেন খবরটা দিই আর বলেছেন মিতিনের হস্টেলের ফিজ বাকি পড়েছে অনেকদিন হল। উনি অসুস্থ তাই কোনও ভাবেই জোগাড় করতে পারছেন না টাকাটা। আমার হাতে আপনাকে টাকা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন কাকু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করলেন মধুরিমা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুটে বললেন, ‘এখন কোথায় আছেন তিনি?”

—হাসপাতালে ভর্তি করেছি। কিছুটা ভালো আছেন। আমি আসতে চাইনি কিন্তু কাকু বারবার জোর করতে থাকায়…

—ভালোই করেছ। এত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা তো হল। চেহারা অনেকটা বদলে গিয়েছে তোমার। কপালের ওই কাটা দাগটা না দেখলে চিনতেই পারতাম না হয়তো। সেবার মামা-ভাগ্নে পাহাড় দেখতে গিয়ে মাথা ফেটে সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! মনে আছে?

মধুরিমার কথা শেষ হতেই পাশে দাঁড়ানো তন্দ্রা ঝটিতি তাকাল সামন্তকের দিকে। তন্দ্রার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কাটা দাগটায় হাত বোলাল স্যমন্তক। একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘সে আর বলতে?”

স্নেহাংশুর অসুস্থতা, মিতিনের হস্টেলের প্রসঙ্গ কোনও কিছু নিয়েই তেমন কৌতূহল দেখাচ্ছিলেন না মধুরিমা। বিষয়টা কেমন অদ্ভুত ঠেকছিল সামন্তকের কাছে। আঠারো বছর আগে দেখা মানুষটা অনেকটাই বদলে গিয়েছেন। এমনকী তাঁর একমাত্র মেয়েকে নিয়েও একটা শব্দ খরচ করছেন না তিনি। তাঁর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, সামন্তকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা— এসব গল্পই তিনি শোনাচ্ছিলেন তন্দ্রা আর স্যমন্তককে।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...