আজও খুব ভোরে বিছানা ছেড়েছি । চা-প্রাতরাশ সেরে সকাল ৮টায় জিপে চড়ে বসেছি। গন্তব্য গন্ধমাদনের বিপরীত ঢালে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হরিশংকর মন্দির। পান্থশালার ম্যানেজারকে বলে গেলাম, আমরা ফিরে এসে লাঞ্চ করব, যদি একটু দেরিও হয়। ড্রাইভার সন্তোষ তার নামের প্রতি সুবিচার করে সদাপ্রসন্ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি চলে এল নুয়াপাড়া রোড-এ। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিল এবং আধ ঘণ্টা পরেই পৌঁছোলাম হরিশংকর মন্দিরের কাছে। এই মন্দির ভগবান বিষ্ণু (হরি) এবং মহাদেব শিব (শংকর)-এর নামে পরিচিত। মতান্তরে, বিষ্ণুভক্ত হরি শবর-এর নামেই মন্দিরের পরিচিতি। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি, পাহাড় থেকে এক ঝরনা নেমে এসেছে মন্দিরের কাছে। হরিশংকর-এর এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয় চৌহান বংশীয় এক রাজার দ্বারা, সেই চতুর্দশ শতাব্দীতে। নৃসিংহনাথ ও হরিশংকর মন্দির দুটির মাঝের উপত্যকা থেকে পাওয়া যায় বৌদ্ধ যুগের বহু ধ্বংসাবশেষ। মনে করা হয়, সেগুলি প্রাচীন বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় পরিমলগিরির ধ্বংসস্তূপ। আরও আবিষ্কৃত হয়, দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি পর্বতগাত্রে খোদিত নৃত্যরত গণেশের চিত্র। এই মন্দির তৈরি করান মহারাজ বৈজলদেব-এর মহারানি দুর্লভা দেবী। মন্দিরে মহাদেব, রাম-সীতা প্রভৃতি বিগ্রহ দর্শন করে জিপে চড়ে বসলাম।

হরিশংকর থেকে যাওয়া যায় ১১০ কিমি দূরে অবস্থিত পাটোরা ড্যাম এবং যোগেশ্বর মহাদেব মন্দির। আমরা সেদিকে না গিয়ে ফিরে চললাম নৃসিংনাথ-এর পথে। গন্ধমাদনের গহনে পৌঁছে দেখতে হবে আরও কয়েকটি সুন্দর স্থান। বেলা ১টার মধ্যেই ফিরে এলাম পান্থশালায়। দ্রুত স্নান সেরে নিয়ে সবাই লাঞ্চ করতে বসলাম। ভাত-ডাল-তরকারির সঙ্গে সুস্বাদু মাছ পেয়ে আমরা সবাই খুশি। গতকাল থেকেই পান্থশালার ম্যানেজার-এর আতিথ্যে বার বার মুগ্ধ হয়েছি আমরা।

আজই শেষ দিন নৃসিংহ নাথ-এ। লাঞ্চ-এর পর তাই আর বিশ্রাম নিয়ে আবার জিপের সওয়ারি হলাম। চলেছি গহন জঙ্গলপথে কপিলধারা ও সুপ্তধারা দর্শন করতে। প্রায় ৪০ মিনিট পরে এসে পৌঁছোলাম বড়ো বড়ো পাথরে ভরা এক জায়গায়। জিপ থেকে নেমে একটু এগিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখি, প্রায় ১০০ ফুট উপর থেকে এক শুভ্র জলধারা পাথরে ধাকা খেতে খেতে প্রবল বেগে নেমে আসছে। সূর্যের আলো সেই ধাবমান জলধারায় প্রতিফলিত হচ্ছে। মিনিট ১৫ সেখানে কাটিয়ে আবার চড়ে বসলাম জিপে । গাড়ি চলল সুপ্তধারা-র পথে। জঙ্গল পথে প্রায় মিনিট ২০ জিপযাত্রার পর এসে পৌঁছোলাম গন্তব্যে। সে এক ভারি সুন্দর এবং ততটাই নির্জন স্থান। সমগ্র অঞ্চলে আমরা ছাড়া আর কোনও টুরিস্ট নেই। প্রাচীন, অখণ্ড নীরবতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম আমি।

প্রসঙ্গত জানাই, সমগ্র গন্ধমাদন-এ চোখে পড়েনি একটিও কাক। কারণ অনুসন্ধান করে জানলাম, পাহাড়ের বক্সাইট জলে মিশে তা অপেয় হয়ে পড়ে কাকেদের জন্য। তাছাড়া, জঙ্গলের ভেষজ গাছপালার তীব্র গন্ধও কাকেদের অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ। অন্য পাখীদেরও বিশেষ দেখিনি এই অঞ্চলে।

পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠেছি একটু দেরিতে। সকালের মিষ্টি রোদে বারান্দায় বসে চা খেলাম। নির্মল প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে আমার মনে এক অব্যাখ্যাত আনন্দ ৷ গন্ধমাদনে নৃসিংহনাথ ও হরিশংকর স্থান দুটি ভারি সুন্দর। স্নান সেরে সকাল ৯টায় প্রাতরাশ করতে বসলাম। গরম ইলি-বড়া-সাম্বার-এ আড়ম্বরহীন খাওয়া। সন্তোষ এসে বলল, বেলা ১০টার মধ্যেই বার হতে হবে। লাগেজ বাঁধা হল বোলেরোর ছাদে। ম্যানেজারের সঙ্গে করমর্দন সেরে বিদায় জানালাম নৃসিংহনাথকে । গাড়ি ধীরে ধীরে গন্ধমাদনের পাহাড়ি পথ দিয়ে নেমে এসে পৌঁছোল সমতল রাস্তায়। পিছন ফিরে তাকালাম না। আর, পাছে আরও মন খারাপ হয়।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:

কীভাবে যাবেন: এই লেখায় বেড়ানোর যে জায়গাগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো রাউরকেলা অথবা সম্বলপুরকে কেন্দ্র করে দেখা যেতে পারে। মুম্বাই বা আমেদাবাদগামী যে- কোনও ট্রেনে চেপে রাউরকেলা স্টেশনে চলে আসুন। স্টেশন থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন বাজেটের কম করেও ৩০টি হোটেল পাবেন। সেখানে থেকে এক এক করে দেখে নিন জায়গাগুলো। রাউরকেলায় থাকলে আরও দেখে নিন হনুমান মন্দির, ইন্দিরা পার্ক, নেহরু পার্ক এবং ডিয়ার পার্ক।

সম্বলপুরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে চাইলে ১২৮৭১ হাওড়া- তিতলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেস, ১৮০০৫ হাওড়া-জগদলপুর সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস ধরে চলে আসুন সম্বলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে প্রথমে সম্বলপুরের আশেপাশে দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে চলে আসুন গন্ধমাদনের নৃসিংহনাথ ও হরিশংকর-এ। তারপর ফেরার পথে রাউরকেলা স্টেশনে নেমে দু’দিনে দেখে নিন বাকি জায়গাগুলো।

কোথায় থাকবেন: রাউরকেলা বা সম্বলপুরে থাকার জন্য হোটেলের অভাব নেই। বড়গড়-এও ৩-৪টি মাঝারি মানের হোটেল আছে।

কখন যাবেন: এই জায়গাগুলো দেখার জন্য সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...