শেষ পর্ব
বিয়ের পর বছর চার কেটে গেলেও হারু ও ফুলমণির কোনও সন্তান জন্মায় না। ফুলমণির মাসের রক্তপাত বন্ধ হয়, পেটে সন্তানের উপস্থিতি বুঝতে পারে। কয়েকমাসের মধ্যে একদিন হঠাৎ রক্তপাত হতে শুরু করে। পরনের কাপড় ছেড়ে রক্ত গড়িয়ে আসে পায়ের দিকেও। এই রক্তপাত বড়োবাবুদের কাছে এটা খুব ভালো খবর হলেও ফুলমণির জন্যে খুবই দুঃখের।
হারু ফুলমণিকেই দোষ দেয়। ঝগড়া করে, খাবার উলটে দেয়, মদ খাবার পরিমাণ বাড়ায়। এমন ভাবেই চার বছর কেটে যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই তিন মাস হল একটা মেয়ে জন্মালেও হারু কিন্তু তার আগের জায়গায় ফিরে আসেনি, বরং একটা গা’ছাড়া ভাব তাকে জাপটে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও ফুলমণি বেশ বুঝতে পারে।
পরের দিন খুব তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে যায়। ফুলমণি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তাঁবুতে হারু নেই। মেয়েটা রাতে বেশ কয়েকবার কেঁদে উঠেছিল, কেমন যেন দম বন্ধ করা কান্না, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কাল সকালেও না কমলে বড়োবাবুর হাতে পায়ে ধরে একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এদিকে সারা রাত বৃষ্টিও পড়েছে। রাতভর সে নিজেও ঘুমোতে পারেনি। ভোরের দিকে চোখদুটো বুজে আসে। ফুলমণি বাইরে বেরিয়ে দেখে বাকি সবাই উঠে গেলেও কাজের কোনও তোড়জোড় নাই।
বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার, এইরকম থাকলে আজ আর কাজ হবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি থেকে পান্তা বের করে নিজে নেয়, হারুর জন্যেও ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়। কিছু সময় পরেই দেখে দূরের চা-দোকানের ওই লোকটা তার দোকান ছেড়ে আরেকটু উপরের দিকে উঠে গেছে। জিনিসগুলো একটা একটা করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটার শরীরের কথা ভেবে ফুলমণি ছেলেদের তাঁবুর কাছে এসে বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমার লোকটা কোথায় গো?’
—পকুরের পানে গেইচে, উ আর সুবলা।
—আজ কাজ হবেক?
—দেখি বাবু যা বলবেক, ম্যাঘ করিছে, জল পড়লে আর কী করে কাজ বাগাব? রাজুয়ার গলা।
ফুলমণি একপা একপা করে দোকানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ রুটি দিবে না?’ দোকানি প্রথমে কোনও উত্তর দেয় না। ফুলমণি আবার জিজ্ঞেস করে। এবার দোকানি বিরক্ত হয়!
—দেখছ না, আজ কী অবস্থা, এক্ষুনি গাড়ি এসে সব ভেঙে দেবে, পিছিয়ে গেলাম। বৃষ্টি আরম্ভ হলে এই মানুষটাকে কোথায় রাখব কে’জানে?’
ফুলমণি তাকিয়ে দেখে দোকানির বউটা সেই একই ভাবে শুয়ে আছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি মাথা নীচু করে নিজের তাঁবুতে ফিরে মেয়েদের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘কাঁদেনি তো?”
—না, শুনি নাই। রুবি উত্তর দেয়।
—আজ তো কাজ হবেক নাই, চল চানট করে আসি গা। একটু ভালো করে রান্না চাপাইতে হবেক।
–তুই উদিকে কুথাকে গিছিলি?
—উই যে, আজ উয়াদের দুকানটা ভেঙি দিবেক বলিছে, সেই…।
টিপ টিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়, ফুলমণি নিজের তাঁবুর ভেতর আসে। মেয়েটা এখনও উঠে নাই। ‘ভালো হল!’
পাশের তাঁবুতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখবার জন্যে বলে ফুলমণি আরও কয়েকজনের সাথে স্নান করতে যায়। ফেরবার সময় একটু দেরি হয়ে যায়। বৃষ্টির জন্যে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হয়েছিল। মাথায় গামছা ঢাকা দিয়ে তাঁবুতে ফিরতেই ভয় পেয়ে যায়। তাঁবুর ভেতর এক পাশে হারু কেমন ভাবে বসে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই।
ফুলমণি তার দিকে তাকিয়ে একরকম আঁৎকে উঠেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’
হারু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, ‘গা-ট ঠান্ডা হয়ে… ‘
ফুলমণি তাড়াতাড়ি মেয়েটার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে, সেই তো এক্কেবারে বরফের মতো ঠান্ডা, নাকের নীচে হাত দেয়, না কোনও শ্বাস পড়ছে না।
ফুলমণি চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটো তাঁবু থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। একজন ফুলমণিদের তাঁবুর ভেতর গিয়ে বাচ্চাটার শরীরে হাত দেয়।
—না আর প্রাণ নাই।
বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যায়। বাইরে তখন মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। নিজেদের তাঁবুতে ফুলমণি কোলে মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা করে। কবর দেবে? কোথায় দেবে? বড়োবাবুকে একবার জানাবে?
ফুলমণির চোখ দুটো কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। পাশে ছেলেদের তাঁবু, ওখান থেকেও কোনও গান বা হাসি-মজার আওয়াজ নেই. ওখানেই হারু বসে আছে। হঠাৎ ফুলমণির দূরের ওই চায়ের দোকানটার দিকে চোখ যায়। পাঁচরকমে খেয়াল করেনি, দোকানটা এক্কেবারে ভেঙে দিয়ে গেছে। ফুলমণির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়।
ভাঙা দোকানের পিছনে একটা খোলা ছাতা দেখতে পায়। ভিতরে দু’জন মানুষ খোলা আকাশের মাঝে একটা ছাতার নীচে বসে আছে। ফুলমণি এক ভাবে দেখে যায়, শুধু দেখে যায়। কোলে মরা মেয়ে, একটু দূরে একটা ছাতার নীচে বসে আছে সেই দোকানি আর তার অসুস্থ বউ। একদিকে তৈরি হওয়া রাস্তার উপর তখন শুধু মুষল ধারার বৃষ্টি পড়ছে।