অভীকের একমাত্র আশ্রয় মা, কিডনির সমস্যায় এখন শয্যাশায়ী। গবেষণার কাজ প্রায় থেমে। স্যারের “বিগ পুশ”-এও কোনও কাজ হচ্ছে না। মায়ের ডায়ালিসিস চলছে মাসে দুটো করে। অনেক টাকার ধাক্কা। একটা চাকরির নিতান্ত প্রয়োজন। তাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্থনীতির সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান গ্রামেরই স্কুল আরামবাগ বিদ্যানিকেতনে। মেধা তালিকার ক্রমসংখ্যা একদম প্রথম দিকে থাকার ফল।
শনিবার বিকেল ও রবিবার গবেষণার কাজে বের হতে হয়। ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পালা বদলের যে-ইতিহাস তৈরি হতে শুরু করেছে তা সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া মোরগ হয় কিনা তার ওপর চলছে ওর গবেষণা। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গ্রামের প্রত্যন্ত পরিবারে একটা উন্নয়নের দিশা দেখাচ্ছে। কিছু মহিলা দল তৈরি করে কাজ করছে।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে যৌথ ভাবে। তাতে দায়বদ্ধতা থাকছে সকলের। সেই ঋণের টাকা আয় উপার্জনকারী কোনও কাজে লাগিয়ে আয় করছে এবং ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে। বাংলাদেশের অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুসের দেখানো পথে চলছে এই ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ’-এর কর্মধারা। উন্নয়নের একটা উদ্দীপনা সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষকতার কাজে অভীকের আগ্রহ নতুন নয়। সংসার চালাতে এর আগে ও প্রাইভেট টিউশনিও করেছে অনেক। বাবার মৃত্যুর পর জমানো টাকায় আর ক’দিন চলবে! ভালো ছাত্র হিসেবে নামডাক ওর টিউশনির পসার বাড়িয়ে ছিল খুব। চাকরিটা পেয়ে ও সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে। ওর বন্ধু প্রবালকে দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু মা, স্কুল, গবেষণা নিয়েই চলছে।
মায়ের কাছে সবসময় থাকার জন্য চম্পা মাসিকে রেখেছে। অসহায় বিধবা চম্পা মাসি ওদের বাড়িতেই থাকে। মায়ের দেখাশোনার সাথে বাড়ির সব কাজই করে। শনিবার স্কুল ছুটির পর, রবিবার ও ছুটির দিনগুলোয় গবেষণার কাজ জোর কদমে করে অভীক।
স্কুলের পরিবেশ বেশ ভালোই। সহকর্মীরা খুব তাড়াতাড়ি ওকে নিজেদেরই একজন করে নিয়েছে। স্কুলের শৃঙ্খলা বেশ ভালো। লেখাপড়ায় ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানও বেশ উঁচুতে। ভালোই চলছে ওর শিক্ষকতার দিনগুলো। বেশ মন দিয়ে কাজ করে ও। মা বলেন – যে অন্ন দেয় তাকে কখনও ঠকাবি না। অভীক স্কুলে ওর সেরাটা দেবার চেষ্টাই করে। সহকর্মীরা ও প্রধানশিক্ষকও খুশি ওর কাজে।
নীচু শ্রেণির ক্লাসে ও গ্রামারটা পড়ায়। ভিত শক্ত না হলে ইংরাজিটা শিখবে কী করে! সিক্স-এর ক্লাসে সেদিন ও সবে ক্রিয়ার কাল শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে পিছনের বেঞ্চে একটি ছেলে মুখ নীচু করে বসে। মাঝে মাঝে ওর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে যেন! কৌতূহলী হয়ে বিষয়টা জানার চেষ্টা করতেই ওর পাশের ছেলে যা বলল তা শুনে খুব কষ্ট হল অভীকের।
যে-ছেলেটি কাঁদছে তার নাম অয়ন। ক্লাশের মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসে মাঝেমাঝে অভীকের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে, অন্য বিষয়েও বেশ ভালো। ছেলেটির রোল পনেরো। পাশের ছেলে রমেন বলল, ওর কান্নার কারণটা।
অয়নরা খুব গরিব। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। ওর মা ক্লাসের চতুর্থ রোল নম্বর, আলোকদের বাড়িতে কাজ করে। আলোক ক্লাসের মনিটর। অয়নের মা লোকের বাড়ি কাজ করে বলে অয়নকে আলোক ‘ছোটোলোক’ বলে গালাগাল করে। ভীতু চেহারার অয়ন কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা অয়নের হয়ে বলতে গেলে আলোক মনিটর বলে উলটোপালটা নাম তুলে স্যারেদের কাছে বকুনি খাওয়ায়।
অয়ন আজ আগে এসে প্রথম বেঞ্চে বসেছিল। আলোক পরে এসে ওর ব্যাগ শেষ বেঞ্চে রেখে ওর জায়গায় বসে। শুধু তাই নয়, আলোক অয়নকে সকলের সামনে বলে – ছোটোলোকের ছেলে সামনের বেঞ্চে বসবি কী! তুই রোজ শেষ বেঞ্চে বসবি। নাহলে তোর নামে উলটোপালটা নালিশ করব স্যারেদের কাছে। রীতিমতো হুমকি! চমকে উঠল অভীক। এইটুকু ছোটো ছেলেটার বুকে এতো ঘৃণা! অয়নের জন্য একটা কান্না যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে অভীকের ছেলেবেলা অয়নের সাথে।
অভীকের বাবার মৃত্যুর পর আশপাশের পরিচিত আত্মীয়দের ব্যবহার, ও ভোলেনি। কথায় কথায় গরিব বলে একটা ঘেন্না ছুড়ে দিত ওদের দিকে। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদত সেই সময়। আগুন চোখে মা শুধু বলত, সুদিন আসবেই। মুখ বুজে অভীক সেই সুদিনের প্রতীক্ষা করে গেছে। ঈশ্বরের দূতের মতো কিছু শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে তখন ও পাশে পেয়েছে। স্যারেরা অভীকের লেখাপড়ায় সব সমস্যা মিটিয়েছেন। তাঁদের, শুধু তাঁদেরই জন্যে অভীক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং আজ গবেষণায়। অয়নের কান্নাভেজা দু’চোখ ওর বুকে ঝড় তুলেছে আজ!
স্টাফরুমে ফিরে ও সহকর্মীদের বলল সব। প্রধানশিক্ষকও শুনলেন সব। পরের দিন আলোকের অভিভাবক-কে ডাকার ব্যবস্থা করলেন। অভীক বুঝল, অয়নের মাকে কালই অপমান করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে ওরা। তাই যা করার আজই করতে হবে। স্কুল ছুটির পর অভীক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে করে অয়নের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোল। দেখল মাটির বারান্দায় অয়নের বাবা শুয়ে।
ক্রমশ…