শেষ পর্ব
অয়নের বাবা রিকশা চালাত। একদিন এক লরির ধাক্কায় কোমরের হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী। অভীক বাড়িতে আর কাউকে দেখতে পেল না। পরিচয় দিতে অয়নের বাবা বসতে বললেন অভীককে পাশে রাখা মাদুরে। অয়নের বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নিয়ে এসেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। কথা বলতে বলতেই অয়ন আর ওর মা বাড়িতে এল।
এদিকে অয়ন পাড়ায় খবর পেয়ে গেছে, স্যার এসেছেন বাড়িতে। খারাপ কিছু হতে পারে তাই মাকে কাজ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে। দু’জনের মুখের ঘাম বলে দিল দৌড়ে এসেছে ওরা। দু’জনের চোখেই একমুখ দুশ্চিন্তা। আশপাশের কিছু উৎসাহী মুখ উকি মারতে লাগল। অভীক ওদের স্বাভাবিক হতে বলে এক গেলাস জল চাইল অয়নের মায়ের কাছে।
অয়নের মা অয়নের মুখে আজকের স্কুলের ঘটনা শুনেছে। রাগে ঘেন্নায় আলোকদের বাড়ি আর কাজে যাবে না বলে এসেছে। অয়ন আগে কখনও জানায়নি আলোকের কোনও কথা ওর মাকে। কাজ চলে গেলে ওদের সংসার চলবে কী করে এই ভেবে!
অয়নের দিকে অভীক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে এখন ও নিজের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছে! অয়নকে কাছে ডেকে নিল। ওর মা বাবাও যেন একটু একটু করে শান্ত হতে থাকল। অভীক ওদের নিজের ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগল। গরিব হলে এরকম ঘেন্না ও নোংরা আচরণ করাটা তথাকথিত পয়সাওয়ালারা যেন নিজেদের অধিকার ভেবে ফেলে। অভীকের কথা শুনতে শুনতে অয়নের পরিবারের সকলে যেন সমব্যথী হয়ে পড়ল। অভীক বুঝল, মাটি তৈরি হয়েছে। এবার বলা যায় ওর প্রস্তাবটা।
অভীক সরাসরি অয়নের মা বাবাকে বলল-কিছুদিন অয়নকে ওর কাছে রাখতে চায়। ওর পড়াশোনার সব দায়িত্ব সে নিতে চায়। সকলকে দেখিয়ে দিতে চায়, গরিবি কোনও অপরাধ নয়। বরং এটা জীবনে এগিয়ে চলার বড়ো একটা প্রেরণা হতে পারে। স্কুল থেকে অভীকের বাড়ি কুড়ি মিনিটের দূরত্বে। স্কুল ফেরত অয়ন প্রতিদিন অভীকের সাথে যাবে ওর বাড়ি। রাতে পড়াশোনা করে অভীকের বাড়িতে খেয়েদেয়ে ফিরবে ওর মা বাবার কাছে। দরকারে অভীক ওকে একটা সাইকেল কিনে দেবে। ওতে যাতায়াতের সুবিধা হবে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অভীকের কাছে পড়তে যাবে অয়ন। ওখানে চান খাওয়া করে ওরা একসাথেই স্কুলে চলে আসবে। শনিবার, রবিবার ও ছুটির দিন অয়ন বাড়িতে থাকবে ওর নিজের মা বাবার কাছে। কারণ ওই দিনগুলোয় অভীক যায় গবেষণার কাজে।
প্রস্তাব শুনে অয়নের বাবা-মার চোখ ভরে জল এল। হঠাৎ অয়নের মা বলে উঠলেন, ঠিকই বলেন মন্দিরের ঠাকুর মশায়! মন থেকে ডাকলে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়। উনি সাহায্য করতে মানুষের রূপ ধরে মাটিতে নেমে আসেন। বেশ জোরেই কেঁদে উঠল অয়নের মা। ওর বাবার চোখেও জল। অয়ন কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। ওর এইমাত্র শোনা স্যারের কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
অভীক আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল। বাবা বলত, বড়ো হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালে তবেই জানবি তোর শিক্ষা সার্থক। ও দেখল, চাঁদের আলোয় ভাসছে অয়নদের সারা উঠোন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভীক চলল মায়ের কাছে। সারা বুক জুড়ে একটা ভালোলাগার নদী বইছে, ছলাৎছল ছলাৎছল!
পরদিন থেকে শুরু হল অয়নের নতুন লড়াই। সহকর্মীরা অভীককে অনেক উৎসাহ দিল। মা অয়নকে যেন নিজের নাতি ভেবে বসে আছে। জোর করে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে। চম্পা মাসিও খুব খুশি। যেখানে বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করা ছেলে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ বয়সে, সেখানে অভীকের মতো মানুষরা অপরের ছেলেকে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
চম্পা মাসিও অয়নকে খুব ভালোবাসে। এক একদিন জোর করে অয়নের বাবা মার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়। স্কুল ও স্কুলের বাইরে অভীকের এই কাজ যেন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে অহঙ্কারী মানুষগুলো ওর কাছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে অয়নের ক্লাসে। আলোক আর ওকে ‘ছোটোলোক’ বলে না। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে। এখন অয়নের মনের মধ্যেও সে দুঃখ-কষ্ট আর নেই।
এদিকে অয়নের লেখাপড়ার উন্নতি, সত্যিই চোখে পড়ার মতো। অভীক মনপ্রাণ ঢেলে ওকে অর্জিত সব বিদ্যা যেন উজাড় করে দেয়। এটা অভীকেরও একটা লড়াই। অয়নের মাধ্যমে সমাজকে যেন ও একটা বার্তা দিতে চায়। একটু সহানুভূতি, একটু বাড়িয়ে দেওয়া হাত অসুবিধায় পড়া মানুষগুলোর জগৎ বদলে দিতে পারে।
সেদিন স্কুল জুড়ে সকলের চোখে মুখে আনন্দ! প্রধান শিক্ষক মহাশয় আনন্দে অভীককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সহকর্মীরা উচ্ছ্বসিত। অয়ন ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে! একটা লড়াইয়ের জয় হয়েছে। অভীক-অয়নের লড়াই ঘুণপোকায় আক্রান্ত নষ্ট হতে থাকা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে যেন এক নতুন দিশা! শিক্ষক ও ছাত্রদের পবিত্র সম্পর্ক যেন আলোয় আলোয় ভরে যায় আগামীতে। অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ- সকলের প্রার্থনা আজ এটাই।
এদিকে কামিনী ফুলের গাছটার নীচে অয়ন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে। প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা চেয়ে চেয়ে দেখছে স্কুলে উপস্থিত ছাত্র, অভিভাবক সকলে। অভীক ওর ছেলেবেলার শিক্ষকদের স্মরণ করল। এ যেন এক গুরুদক্ষিণা ওর। হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালে আঁকা সেই দাড়িবুড়োর দিকে। মুচকি হেসে যেন বলছেন, কিছুই হারায় না। রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!