প্রথম সারির অভিনেতা সুবিমল রায়ের একমাত্র ছেলের বিয়েতে ফোটোগ্রাফির অর্ডার পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। অহংকারে মাটিতে পা পড়ছিল না শুভজিতের। বদলে মুচকি হেসে বলেছিলাম, ‘তা ভাই বেশ তো, আশপাশের মানুষগুলো যদি উন্নতির শিখরে পৌঁছোতে পারে এবং সেটা যদি আবার বন্ধুবান্ধব হয়, শুনে ভালোই লাগে।’

তারপর কেটে গেছে তিনটে দিন। কাল থেকে গা-টা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। সেদিন শুভজিৎদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বটে। তাই বুঝি, হালকা টেম্পারেচার এসেছে। তার উপর ইয়ার এন্ডিং এর কারণে অমানুষিক কাজের চাপ। শরীর আর দিচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ-ই অন্বেষা, মানে শুভজিতের বউয়ের ফোন। উৎকণ্ঠিত গলায় খবর দিল শুভজিতের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়েতে, ফোটোগ্রাফির কাজ সেরে ফেরার সময়, যে-গাড়িতে ফিরছিল সেটা লরির ধাক্কায় উলটে গেছে। জরুরি অবস্থায়, স্থানীয় লোকেরা পাশেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এখন আইসিসিইউ-তে।

এরকম একটা খবর শুনে কি থাকা যায়? শরীরের কথা ভুলে অগত্যা ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমাকে দেখা মাত্রই অন্বেষার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খানিক আশ্বস্ত করার জন্য এগোব, ঠিক তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার জানালেন, পেশেন্টের অবস্থা যথেষ্ট সংকটজনক, ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা সম্ভব নয়।

অতএব অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই আমাদের। সবকিছু এখন উপরওয়ালার হাতে। অপেক্ষমান মূর্তির মতো আইসিসিইউ-এর সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম আমরা দুজনে। অন্বেষাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল।

একবার জিজ্ঞাসাও করলাম, ‘একটু চা খাবি? ভালো লাগবে।’ কোনওরকমে ঘাড় নাড়িয়ে না বলেই বেঞ্চে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বুজল। সত্যিই মেয়েটাকে দেখলে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিনও সুখ পেল না।

মনে পড়ে অতীতে শুভজিৎ আর অন্বেষার প্রথম সাক্ষাতের কথা। অন্বেষা তখন বিকম পাশ করে চাকরি খুঁজছে। এ-অফিস সে-অফিসে দরখাস্ত জমা দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাকেও বলেছিল, ‘ভানুদা তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে, দেখো না কোথাও যদি কোনও সুযোগসুবিধা থাকে।’

ভানু আমার ডাকনাম। আমার ঠাকুমার দেওয়া বড়ো আদরের নাম। আমাদের বাড়ির পাশেই অন্বেষার মামারবাড়ি। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ায় ও মামার বাড়িতে দিদার কাছেই বেশি থাকত। সেই থেকেই আমি ওর ভানুদা। আমার থেকে বছর সাতেকের ছোটো। কোনও অসুবিধা হলেই ভানুদা আছে।

সেই সময় আমাদের অফিসেই অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্টে একটা পদ খালি ছিল। মালিককে বলেকয়ে একটা চাকরির বন্দোবস্ত হয়েছিল। তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল অন্বেষা। ঘটনাক্রমে ওইদিন শুভজিৎও হাজির। সেই প্রথম দেখা দুজনের।

অন্বেষা খুব সুন্দরী না হলেও বেশ একটা আলগা চটক রয়েছে। কথাবার্তায়ও পারদর্শী। কথার মারপ্যাচেই বিশ্বজয় করতে পারে সে। তার উপর অল্পবয়সি অমন চটপটে মেয়েকে ভালো লাগাই স্বাভাবিক।

জয়েনিং ডেট অনুযায়ী ৩ অক্টোবর অফিস জয়েন করল অন্বেষা। দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় করানো ছাড়াও ওর কাজও বুঝিয়ে দিলাম আমি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়ে গেল, ‘সাহেব, নতুন ম্যাডাম খুব ভালো। এত মিষ্টি কথা বলেন যে অন্যান্য সাহেবরাও খুব তারিফ করেন ওনার।’

শুভজিৎ মাঝেমধ্যে আমার অফিসেও আসত। খেয়াল করে দেখেছি, ও আমার সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ থাকত অন্বেষার দিকে। একদিন তো বলেই ফেলল, “আরে বস, এটা ওই মেয়েটা না, সেদিন যাকে তোদের বাড়িতে দেখেছিলাম?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। আসলে সেদিন ও বাড়ি ফেরার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিল, যে তোর সঙ্গে ওর পরিচয় করানোটাই সম্ভব হয়নি। তবে মনে হচ্ছে তোদের পরিচয়টা খুব শিগগিরি করাতে হবে।’

ঠিক সেই সময় দেখলাম অন্বেষা ফাইল হাতে অ্যাকাউন্টট্যান্ট রতনদার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রতনদা অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে অন্বেষা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমার দিকে তাকাতেই ইশারা করে ডাকলাম। দু’এক কথায় রতনদাকে মনে হয় কিছু বলল, হয়তো আপনি ফ্রি হলে আসছি’ এমন কিছু। তারপর সোজা আমার টেবিলে।

‘আরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বস।’

একটু হেসে অন্বেষা জবাব দিল, ‘না না ঠিক আছে। কিছু বলবে?’

‘বলছি বলছি আগে বস। খানিক বসলে তোর কাজের এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’

বসতেই হল অন্বেষাকে। এদিক-ওদিক টুকটাক কিছু কথা হওয়ার পর, সপ্রতিভ ভাবে বললাম ‘দেখেছিস তোদের আলাপটাই করানো হয়নি। অন্বেষা এ হল শুভজিৎ।’ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিনিময় হল দুজনের। বললাম, ‘আমার কলেজের বন্ধু, ‘আজকের বার্ত’-র ফোটোগ্রাফার। পাশাপাশি অবশ্য একটা স্টুডিয়োও চালায়। আর এই হল অন্বেষা। আমার কলিগ কাম বোন, আবার বন্ধুও বলতে পারিস। ভারি মিষ্টি মেয়ে।’

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অন্বেষার মুখ। বলে, ‘সত্যি ভানুদা তুমিও না ।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...