আমি বাধা দিয়ে বললাম, “না না সেসব কিছু নয়। ও অনেক বড়ো প্রতিভার মালিক, আমি ওর তুলনায় কিছুই নই! কিন্তু আপনি কী করে শুভকে, আই মিন ড. পাণ্ডেকে জানলেন?’

আইরিন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ছোটো মেয়েটির মতো কেঁদে ফেলল, ‘ড. মিত্র, আমিই সেই হতভাগিনী যে জানকী আর শুভঙ্করকে আলাদা করে দিয়েছিল।’

আমি তোতলাতে তোতলাতে উচ্চারণ করলাম, ‘আইরিন, তুমি, মানে আপনি… আর কথা খুঁজে পেলাম না আমি।” আইরিন এবার নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আপনি নয়, তুমি! ড. মিত্র আপনি শুভঙ্করের প্রিয় বন্ধু, সত্যিকারের একমাত্র বন্ধু। আপনি বলে আমাকে অপমান করবেন না প্লিজ।’

আমিও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আইরিন, “ওটা তোমার ভুল ধারণা ভাই। শুভ ওদের মানে জানকী আর রাহুলকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, ওরাই যেতে চায়নি। আর তুমি না থাকলে শুভ আজ যেখানে পৌঁছেছে তার কাছাকাছিও পৌঁছোতে পারত না।’ আইরিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি পরিস্থিতি বদলাবার ইচ্ছায় বললাম, ‘কিন্তু তুমি এখন যাচ্ছ কোথায়? একা কেন? সেই বিশাল বৈজ্ঞানিকের বুঝি দু’দিনের জন্যও ছুটি নেই?’

আইরিন এবার জোরে কেঁদে উঠল। আমি অবাক হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি আকাশ-পাতাল ভাবছি— কী হল, হঠৎ কেন এমন করে কাঁদছে?

এমন সময় রাত্রি শেষের ফিসফিসানি হাওয়ার স্বরে আইরিন বলে উঠল, ‘সে যে আমাদের সবার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেছে দাদা’, বলে আইরিন আমার দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আমি বজ্রাহতের মতো স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হল না। কেবল অশ্রুতে আমার শার্টের বুকটা ভিজে গেল।

তাহলে কি সংবাদপত্রে বেরনো সত্ত্বেও, আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল এত বড়ো খবরটা!

অনেক পরে আইরিন নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে ওর সিটের কাছে গিয়ে একটা ব্যাগ খুলে ছোট্ট একটি স্টিলের কলশি বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এতেই রয়েছে আপনার প্রিয় বন্ধু শুভ, আই মিন ওর দেহ-ভস্ম, নিয়ে যাচ্ছি মাধোপুরের মাঠেঘাটে আর দশাশ্বমেধ ঘাটে ছড়িয়ে দিতে। এটাই ছিল ওঁর শেষ ইচ্ছা।’

আমি সজল নয়নে কলশিটাকে সজোরে জড়িয়ে ধরে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সিটের উপর অসহায়ের মতো বসে পড়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম।

একটু পরে ক্লান্ত ট্রেনটাও যেন পা ঘষটাতে ঘষটাতে অতি ধীরে বারাণসী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়ে গেল!

আমি হাত ধরে আইরিনকে নামতে সাহায্য করছিলাম এমন সময় আমার নাতি মানু দৌড়ে এসে হাত ধরে নামিয়ে আমাদের প্রণাম করল। ওর সঙ্গে প্রায় ওরই বয়সি একটি ছেলে এসে আমাকে আর আইরিনকে প্রণাম করল। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মানুর দিকে তাকাতেই ম্লান হেসে আইরিন বলল, ‘ও, রাহুল, আমি আসতে লিখেছিলাম।’

আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম রাহুলের পানে। যেন ঠিক শুভঙ্কর দাঁড়িয়ে! কয়েক যুগ আগে সেই অনিন্দ্যসুন্দর হাসি হেসে যেন বলল, “মিত্র সাব, নাও তোমার জন্যে অমৃত নিয়ে এসেছি।’ আমার হাতে তখনও আইরিনের দেওয়া কলশিটা। রাহুল কলশিটা স্পর্শ করে ভক্তিভরে প্রণাম করল।

আমি ফিসফিসিয়ে আপন মনে উচ্চারণ করলাম, ‘শুভ, আমার প্রিয় মিত্র, আমার বন্ধু, আমার সখা – আমি জানি না অমৃত কী? কেমন দেখতে? কী তার রং, গন্ধ বা কেমন তার স্বাদ! কিন্তু এই যদি অমৃত লাভের আরাধনা হয়, তাহলে কাজ নেই ভাই আমার এমন অমৃতে।’

মানু এগিয়ে এসে আমাদের জিনিসপত্র তুলে নিল। যাত্রীদের ধাক্কা থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য রাহুল আর আইরিন এসে দু’পাশ থেকে আমাকে ঘিরে চলতে চলতে বলল, ‘সাবধানে চলো।”

স্টিলের কলশিটা তখনও বুকে চেপে ধরে আমি যন্ত্রচালিতের মতো হেঁটে চললাম বারাণসী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...