শেষ পর্ব
নেগেটিভিটিতে ভরপুর জীবন তারক সিং-এর। ভালো চিন্তা কিছু নেই, সর্বক্ষণ দুঃখী ভাব। তার শরীরের কলকবজা বিকলের কাহিনি, প্রায় প্রত্যহ এদের শুনতে হয়। কেষ্ট দাস ঠিক তার উলটো। সর্বসময় প্রাণচঞ্চল তেজি ঘোড়া। একেবারে টগবগ করে ফুটছে। তবে মুখে কোনও লাগাম নেই। ‘অমিতসাব, পাক্কা দো’দিন মেরা টয়লেট নেহি হুয়া।’ বললেন তারক সিং। অমিতবাবু কিছু বললেন না, তিনি নিজেই বেশ ক’দিন ধরে নড়বড়ে। মুখ খুললেন কেষ্ট দাস।
—কোনটা বন্ধ, হিসি না হাগু?
—নেহি, ও তো কর রাহা, লেকিন হা…
—পিছনে বাতি দিন, সেরেফ বাতি।
—দূর মশাই, কী যে বলেন! হেসে ফেলেছেন অমিত সেন।
—কেন, লজ্জার কী আছে দাদা! ছেলেবেলায় আমরা সবাই তো…, হো হো করে হাসছেন দু’জনে। তারক সিং-ও গাঁদাল পাতা গেলা মুখ করে হাসতে বাধ্য হলেন। এইসব করে যখন অমিতবাবু ফ্ল্যাটে ফিরলেন নীচের পাম্পের ঘরের সামনে বেশ কয়েকজন আবাসিকের জটলা। আষাঢ়ে মেঘের ইঙ্গিত পেলেন অমিতবাবু। চারতলার গঙ্গাগোবিন্দবাবু, তিনতলার ভিনেশ জোশি, দোতালার অটল সাঁপুই, ডাঃ নিতিশ মিত্র— সবাই আছেন। কেমন যেন ভিলেন ভিলেন গন্ধ খুঁজছে সবাই তাঁর শরীর থেকে।
অটল সাঁপুই কিছুদিন আগে ছানি কাটিয়ে এসেছেন। চোখের দৃষ্টি বেড়ে গেছে, তিনি কাছে এসে খুব একেবারে গোয়েন্দা কায়দায় মাপতে লাগলেন অমিতবাবুকে। অমিতবাবু বুঝতে পারলেন না, কী খুঁজছেন রিভলবার না রক্তমাখা ছোরা! আসরে প্রথম এগিয়ে এলেন ভিনেশজি।
—আপনি কী করলেন মিঃ সেন? ওয়াটার পাম্প একদম খারাপ করিয়ে দিলেন। অমিতবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
গঙ্গাগোবিন্দ মণ্ডল সংক্ষেপে যা বললেন তার সারমর্ম হল, ‘সকালে অমিতবাবু পাম্প চালিয়ে চলে গেসলেন। আবাসিকরা কেউ তা জানতেন না। দীর্ঘক্ষণ চলায় পাম্পের মোটর পুড়ে গেছে। সারাই করতে অনেক টাকার ধাক্কা।’
নিতিশ মিত্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, “তিনি এই বাবাদ এক কানাকড়িও দেবেন না।’ অমিতবাবুর মনে হল অন্য সকলে নির্বাক থেকে নিতিশবাবুর মতেই মত দিলেন। আর এখানে দাঁড়ালেন না তিনি। তিনতলায় তাঁর নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজালেন। কাজের লোক বুলি দরজা খুলল। এখানেও সন্দেহের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এক গেলাস জল খেয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিলেন। হঠাৎ হাত থেকে কে যেন টেনে নিল কাগজটা। স্ত্রী, বিমলা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে চেক বই।
স্ত্রীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। থমথমে মুখ। ভয় পেলেন অমিতবাবু, কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন। মুখ খুললেন বিমলা। পাম্পটা ঠিক করতে প্রায় বারো হাজার টাকা লাগবে। আমি কল মিস্ত্রী রাজু-কে খবর দিয়েছি। ও একটু বাদে এসে চেক নিয়ে যাবে। কোনওরকম ভূমিকা না করে চেকবইটা সামনে রেখে চলে গেল বিমলা।
আমিতবাবু বুঝতে পারলেন এই বাড়ির বারোটা ফ্ল্যাটেই তিনি এখন খলনায়ক! শুধু জানতে পারলেন না, খবরটা চেন্নাই-তে ছেলে অত্রি অবধি পৌঁছেছে কিনা! যাই হোক, নিজের ভুলের মাশুল চোকাতে বারো হাজার টাকার একটা চেক লিখে টেবিলের উপর কলম চাপা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বিমলাদেবী দেখলেন কিন্তু বাধা দিলেন না। লোকটার মনেপ্রাণে আজ একটু মুক্ত হাওয়ার দরকার।