তারপর আর কিছু মনে নেই অঙ্গিরার। তবে বেশ কিছুক্ষণ অঙ্গিরাকে পাওয়া যায়নি। চারদিকে সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিল। শেষে নির্জন দুপুরে রেশন দোকানের পাশে একটা কানা গলিতে অঙ্গিরার শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল। অচৈতন্য। কষের ওপর গড়িয়ে পড়া শুকনো রক্তের দাগ। সারা গায়ে শেয়াল শকুনের ছিঁড়ে খাওয়ার চিহ্ন। খবর দিয়েছিল, ওদেরই পরিচিত এক দুধাওয়ালা। দেখে চিনতে পেরেছিল অঙ্গিরাকে। বহুকষ্টে রঙ্গনের জন্য সযত্নে তুলে রাখা তার অরক্ষিত যমুনা এক লহমার ভুলে তছনছ হয়ে গেল। মাসখানেক লেগে গেল প্রায় অঙ্গিরার সুস্থ হতে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। শরীরের ক্ষত মেরামত হলেও, মনের ভেতরের গভীর দাগ কেউ মুছে দিতে পারল না। মনস্তত্ববিদের সহায়তা নিতে হল।
মানসিক স্বাস্থ্য কিছুটা ঠিক হবার পর একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অঙ্গিরা। সেটা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা সে নিজেই জানে। কিন্তু বাকিদের কাছে, বিশেষ করে বড়ো অবাক ঠেকল রঙ্গনের কাছে। ক্রমশ সে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইল রঙ্গনের কাছ থেকে। কথার জালে রঙ্গন অনেক বোঝাতে চাইত কিন্তু ফল খুব একটা কিছু হল না। অঙ্গিরা তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাইল রঙ্গনের নাম। তার জীবনের সেইসব স্বপ্নের দিনগুলোর গভীর দাগ আবছা করে দিল তার জীবন থেকে। নিজেকে মনে করতে লাগল অপবিত্র। তার নিজের শরীরটাই মনে হতে লাগল, তার কাছে পাপের বোঝা। সেই পাপী শরীর মনকে অনেক দূরে সরিয়ে নিল এতদিনের লালিত পবিত্র সম্পর্ক থেকে। এদিকে রঙ্গন তো নাছোড়বান্দা। সে প্রাণের বিনিময়ে হলেও, যে করেই হোক পেতে চায় তার প্রাণাধিক অঙ্গিরাকে।
তবে অঙ্গিরার বাড়ির পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল। বিনা দোষে অঙ্গিরার শরীরে এক গাঢ় কলঙ্কের দাগ এঁকে দিয়েছিল সমাজ। তাই বাড়ি থেকে চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে সামাজিক লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পেতে। সবাই তো আর খারাপ হয় না। এগিয়ে এল এক সহৃদয় পরিবার। ছেলেটিও বেশ ভালো। ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মী। বড়ো অমায়িক ব্যবহার। পুলক সব জেনেও রাজি হয়ে গেল অঙ্গিরাকে বিয়ে করতে। অঙ্গিরার বাড়ি থেকে ক্রমশ চাপ বাড়তে লাগল বিয়ের। বেঁকে বসল অঙ্গিরা। অবশ্য রঙ্গনকে বিয়ে করতে চাইলে, অঙ্গিরার বাড়ির লোকের কোনও আপত্তি নেই।
রঙ্গনের-ও অমতের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রঙ্গন প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল বোঝানোর। কিন্তু অঙ্গিরা কোনওমতেই রঙ্গন বা অন্য কাউকেই বিয়ে করতে রাজি হল না। কিছুতেই না। তবু ওর বাড়ির লোক এক প্রকার বাধ্য হয়েই শুরু করল বিয়ের তোড়জোড়। অঙ্গিরা হাপুস নয়নে আত্মসমর্পণ করল রঙ্গনের বুকে। যেভাবেই হোক এই উভয়সঙ্কট থেকে উদ্ধার করে দিতেই হবে তাকে।
বহুরকম আলোচনাতেও কোনও সমাধান সূত্র বেরোল না। অগত্যা আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথই খোলা থাকল না তাদের। অঙ্গিরা নিজের জীবন শেষ করে দিতে রাজি হলেও রঙ্গনকে সে কিছুতেই মরতে দিতে চায় না। এদিকে অঙ্গিরা নিজেকে শেষ করে দিলে, রঙ্গনের পক্ষে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থহীন।
অবশেষে আলোচনার ঝড় থেমে যাওয়ার পর দু’জনেই এক নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ ওদের জীবনে খোলা নেই। পরিকল্পনা শুরু হল। যেদিন স্থির হল তার মোটামুটি এক সপ্তাহ পরেই অঙ্গিরার বিয়ে। রঙ্গন অঙ্গিরাকে সবচেয়ে কষ্টহীন মৃত্যুর পথ দেখাল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরঘুমে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ।
উতলা হয়ে উঠল অঙ্গিরা। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে উঠল, “আর তুমি?”
শান্ত গলায় উত্তর দিল রঙ্গন, ‘তুমি যেদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে, দেখবে আমি তোমার পাশেই আছি। মৃত্যুর পরে তুমি যেখানেই যাও, দেখবে আমি তার আগেই সেখানে গিয়ে তোমার জায়গা করে রেখেছি আমার পাশেই। তুমি নিশ্চিন্তে মৃত্যুবরণ করতে পারো। আমি নিজে তোমায় ওষুধ এনে দেব।”
নিশ্চুপ হয়ে গেল অঙ্গিরা। অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রঙ্গনের দিকে। সুখের দিন পার হয় দৌড়ে, দুঃখের দিন খুঁড়িয়ে। চোখের পলকে যেন কেটে গেল মাঝের ক’টা দিন। এসে গেল সেই মহা অশুভ সময়। রঙ্গন গোপনে এসে অঙ্গিরাকে দিয়ে গেল সেই শিশিভরা মৃত্যুবাণ। হাত থেকে ওষুধটা নেবার সময় হাতে হাত লাগল দু’জনের। শেষ স্পর্শ। দু’জনের অপলক দৃষ্টি। আঙুলে আঙুল ছাড়তে চাইছে না। প্রবাহিত হচ্ছে এক অনাদি অনন্ত ভালোবাসার স্রোত। চোখ ভিজে উঠছে দু’জনের। মনের বিরুদ্ধে জোর করেই বিদায় নিল রঙ্গন। ওষুধের শিশি নিয়ে ঘরের দরজায় খিল দিল অঙ্গিরা।
এরপরেই ঘটনা মোড় নিল এক অপ্রত্যাশিত বাঁকে। পুরো ওষুধের শিশি গলায় ঢেলে দিল অঙ্গিরা। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে যেন ওষুধের শিশির লেবেলটা। টেবিলে রেখে দিল শিশিটা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে অঙ্গিরার। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা ব্যর্থ করে ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই অঙ্গিরার। হঠাৎ ভীষণ চিৎকারে ঘুম ভাঙল। দরজায় সজোরে ধাক্কার আওয়াজ। ভেঙে পড়ার জোগাড়। ধড়মড়িয়ে উঠল অঙ্গিরা। বাধ্য হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। সবাই দৌড়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই দেখে টেবিলের ওপর ঘুমের ওষুধের শিশি। পুরোটাই ফাঁকা। ধরাধরি করে বাকিরা শুইয়ে দিল অঙ্গিরাকে।
(চলবে)