আকাশে চতুর্দশীর চাঁদ। অন্ধকারে উঠোনের প্যাসেজের বাঁকে ঘুম চোখে খাড়া খাড়া চুল, ঘাড়ে মাথায় কাপড় জড়ানো আচমকা তাকে দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারায় দিদি। তারপর বাড়িময় আলো জ্বলে ওঠে। দাদা এসে কাঁধে হাত রেখে, জোরে জোরে ঝাঁকায় প্রবালকে।

—ভূতের মতো চেহারা নিয়ে রাতবিরেতে না উঠলেই তো হয়। কাল থেকে শোয়ার আগে জল খেয়ে, বাথরুম করে, বিছানায় ঢুকবি, মনে থাকে যেন।

সেদিন বাকি রাতটা শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষায় বিছানায় বসে ছিল। ‘আনপড়’ বামন মানুষেরা কী করে তাদের পেটের ভাত জোগাড় করে? এই রূঢ় প্রশ্নটার মুখোমুখি মাত্র ষোলো বছর বয়সেই এসে তাকে দাঁড়াতে হল। সে বোঝে, বহু দৈহিক কাজ তার নাগালের বাইরে। অথচ শরীরে দৈত্যের শক্তি। আর মগজ? প্রবাল জানে, সবকিছুর বৃদ্ধি তার শরীরে থেমে গেলেও সুযোগ পেলে বহু বুদ্ধিজীবীকে আজও টপকে দিতে পারে। মগজ আজও প্রখর। শিক্ষার সুযোগ পেলে সেও অনায়াসে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র কিংবা কম্পিউটার এক্সপার্ট হতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেওয়া হল না। ভোর হতেই মার বিছানার পাশে গিয়ে বসেছিল প্রবাল।

—ভয় নেই মা, মরতে যাচ্ছি না। কাজের খোঁজে যাচ্ছি। আশীর্বাদ করো আমাকে। মা প্রভাবতী শুনে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। আর কাউকেই বলেনি সেদিন।

নতুন সূর্যের আলো মাড়িয়ে একা একা রেল বাজারের ভেতর রাজ্য প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন দফতরের শাখা অফিসের বন্ধ দরজার সিঁড়িতে গুটিগুটি এসে বসেছিল। অপেক্ষা, শুধু দরজা খোলার। নানান প্রশিক্ষণের ভেতর মেশিনারিজ ট্রেড, কার্পেন্টারি এমনকী টেলারিং ট্রেডও ছোটো ছোটো হাতে পায়ে অসম্ভব মনে হল। অবিরাম দু’চোখের কোল ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়। বাড়িতে মা বাদে সবার চোখেই তখন সে একজন ভৃত্যের বেশি নয়। কবে আসবে মুক্তি? অবশেষে, বিচিত্র এক কাজের প্রশিক্ষণে নিজের দিশা খুঁজে পায়। আর মেধাবি বলেই হয়তো দামি রেস্তোরাঁর কন্টিনেন্টাল-মোগলাই খানার রসুইঘরে শেফের সহায়কের ওই প্রশিক্ষণে অল্পদিনেই তুখোড় পারফরম্যান্স দেখাল প্রবাল। প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন শাখা অফিসের সেক্রেটারি পৃথিবী সাতকড়ি পার্সোনাল ইনফ্লুয়েন্সে প্রৌঢ় মালিক গণেশ বাজাজের ‘ডিভাইন চয়েজ’ বার কাম রেস্তোরাঁতে তাকে ভিড়িয়ে দিল।

বছর চারেক দুর্বিষহ অনুশীলন বৃত্তি এবং বাড়ির প্রতিটি মানুষের অনুকম্পায় বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন খালাস দিল তাদের। রেস্তোরাঁ মালিক প্রৌঢ় গণেশ বাজাজ দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে খুশি হয়ে প্রবালের দীর্ঘদিনের একটা প্রার্থনা শেষে মেনে নিলেন। একচিলতে একটা প্রায় অন্ধকার খুপরি ঘর থাকার জন্য দেওয়া হল। রেস্তোরাঁ চালু হওয়ার প্রথম দিকে এটা ছিল স্টোররুম। অতটুকু স্টোরে কাজ হয় না বলে পুরোনো পরিত্যক্ত সামগ্রীর ‘জাংক রুম’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন দু’বেলা খাওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছে। তিনজন স্টাফ শুধু এই সুবিধাটা পায় এখানে। সিকিউরিটি রামাচন্দ্রন, জমাদার পরিতোষ পান্ডা, আর সে। মাত্র এক খামচা টাকা তাই মাস ফুরোলে হাতে আসত প্রবালের। যাতে নিজের তেল সাবানের খরচ তুলতেই হিমসিম খেতে হতো।

ঈশ্বরের করুণাই একদিন তার ওপর আবার বর্ষিত হল। সত্যি জীবনে তার এই বিকৃত শরীর, তার মতো একটি অশিক্ষিত যুবকের কাছে অভিশাপ না আশীর্বাদ তা এখনও বুঝতে পারে না প্রবাল। কিন্তু মানুষ যে অসহায় মানুষকে ‘পণ্য’ করে, এটা সে পরিষ্কার বোঝে। আর এই পণ্যের বাজারে সবচেয়ে চাহিদা হল এই মানবদেহের।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...