‘মানবদেহ রইল পতিত

আবাদ করলে ফলত সোনা…’

কিন্তু! হায় রে পেট! আর এই পেটের জন্যেই আজ এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজা, কাল ‘স্যার চার্লি চ্যাপলিন’, পরশু সার্কাসের ‘ক্লাউনের’ সাজে ভাঁড়ামো করতে হয় প্রবালকে। মা বেচারি একসময় খুব কাঁদত, কিন্তু কী করা যাবে! বাগানে অনেক চারাগাছ-ই তো এমনি এমনি জন্মায়, ঠিকঠাক বাড়ে না— অথচ ফলফুল হয়। তাতে লোক বাহবাই দেয়। ‘দ্যাখ দ্যাখ কতটুকু গাছে কেমন ফুল ফুটেছে। ফল ধরেছে দ্যাখো— এই ছোট্টো গাছটায়।’

কেউ ওদের ‘বামন’ বলে না। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ঢিল ছুড়ে মারে না। দুধের শিশুদের ভয় দেখাতে মায়েরা আঙুল তুলে দেখায় না, ওই দ্যাখ কে দাঁড়িয়ে ওখানে। ধরে নিয়ে যাবে কিন্তু। ভ্যাঁ করে ভয়ে কেঁদে ওঠে না কোনও শিশু তাদের দেখে।

তিন ভাই বোনের ভেতর হঠাৎ যেই না প্রবালের বাড় বন্ধ হয়ে গেল, সে হয়ে গেল সবার করুণার পাত্র। বাড়িতে সেই ছিল একদিন সবার সেরা। ও তো নিজে থেকে ওর বাড়বৃদ্ধি বন্ধ করেনি। প্রকৃতিরই মাটিতে টান পড়ল একদিন তাকে গড়ে তুলতে। তৈরি হল এক বামন।

ক্লাস ফোরে প্রাইমারি স্কুল শেষ হতেই ডে সেশন হাইস্কুল। ক্লাস সেভেন তখন তার, ক্লাসে ছোটোবেলার প্রিয় সহপাঠীদের ছোটোখাটো খাতার পাতা ছেঁড়া হাতে পাকানো কাগজের গোলা এসে পড়তে লাগল গায়ে। বয়ঃসন্ধির ওই শুরুতেই আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে থাকল এক এক করে খর্বতার লক্ষণ। গিঁট বেঁধে যেতে লাগল হাতের পাঞ্জা আর পায়ের গুলিতে। মুখমণ্ডলে বিকৃতি। খাঁদা, থ্যাবড়া।

ক্লাস এইট-এ ওঠার পর স্কুল যাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল। ওকে দেখে প্রিয়বন্ধুদের মায়েরাও নিজেদের ভেতর গা টেপাটেপি করে। অথচ একদিন ওইসব কাকিমারাই তার ইংরেজি নোটস-এর জন্য কাড়াকাড়ি করত। মেধা তালিকায় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে তার স্থান থাকত। আর ওটাই যেন আরও বৈরী করে তুলল সবাইকে। নবম শ্রেণিতেই পড়াশোনায় ইস্তফা দিতে হল। প্রিয় সব বইখাতাগুলিকে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে সেদিন কেঁদেছিল। দাদা প্রত্যয় তখন বিএসসি ফাইনাল দিচ্ছে। দিদি সুধা বিকম প্রথম বছর। বাবা চাকরি থেকে সবে রিটায়ার করেছেন। দিদির একটা বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হতে হতে শেষ অবধি ভেঙে গেল। সেই প্রথম জন্মদাতা বাবার মুখে তার শরীরের বিকৃতি নিয়ে ক্ষোভ শুনল…

—এই নাটাটার জন্য সুধার অত ভালো সম্বন্ধটা ভেঙে গেল, বুঝলে সুধার মা! ছেলের বড়োমামা বলছে, এ নাকি জিনের গোলমাল। বংশে ফিরে ফিরে আসে। ও মানবক। সুধার ছেলেমেয়েদেরও যে তা হবে না কে বলতে পারে? বলো, তুমি কী জবাব দেবে এর?

প্রবাল মাথা নীচু করে অন্ধকার বারান্দার কোণে চুপচাপ বসেছিল। একবারও মরে যাবার কথা ভাবেনি সেদিন!

ছোটোবেলায় প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মায়ের গা ঘেঁষে বসে লক্ষ্মীর পাঁচালীতে শুনেছে, আত্মহত্যা মহাপাপ, নরকে গমন। ফুটপাতে পার্কের রেলিং-এর গায়ে টাঙানো নরকের একটা ভয়াবহ ছবিও দেখেছে। সে সময় জানত না, একদিন রাতের অন্ধকারে তাকে দেখেই অতি প্রিয়জনেরও গা ছমছম করে উঠবে। স্কুল বন্ধ হওয়ার বছর দেড়েক বাদে সেদিন মাঝরাতে নানান এলোমেলো ভাবনায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তাই চুপিচুপি বাথরুম থেকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ঘাড়ে মাথায় ভিজে গামছা জড়িয়ে নিজের বিছানায় ফিরছিল প্রবাল। দিদিও বাথরুমে যাবে বলে তখন উঠেছিল।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...