২ পর্ব
পড়শিদের চিৎকার আর আলোচনা শুনে শ্রাবণী জানতে পেরেছিল, ওর জ্ঞাতিরা তার মা-বাবাকে মেরে ওদের জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দু’য়েক বাদে গাঁয়েরই এক পিসে ওকে বুঝিয়েছিল, এভাবে পথে পথে কেঁদে বেড়ালে, না আর বাপ-মাকে খুঁজে পাবি; না জোটাতে পারবি পেটের ভাত। তার চেয়ে আমার সাথে চল, কলকাতার একটা অনাথ আশ্রমে ভর্তি করিয়ে দেব’খন। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই যেমন একটা পাবি; দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে দু’অক্ষর লেখাপড়াও শিখতে পারবি। পথে পথে ভিক্ষে করে আর বেড়াতে হবে না তোকে।
কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পরে, সেই পিসেকে আর খুঁজে পায়নি শ্রাবণী। পরে জিআরপি’র এক পুলিশ অফিসার কাকুর কাছ থেকে শ্রাবণী জেনেছিল, ওটা তোর পিসে না ছাই! ওটা শিশু পাচার চক্রের একটা দালাল। তোকে বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে, তোকে ফেলে রেখে এখান থেকে পিঠটান দিয়েছে।
হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে, পূর্বপ্রান্তের রাস্তার ওপারে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে, সেইদিন দুপুরে মাছ-ভাত খাইয়ে, রেল-পুলিশের অফিসার শ্রাবণীকে ওই ভাতের হোটেলে রেখে দিয়ে, চলে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আপাতত তুই এখানেই থাক, টুকটাক ফাই-ফরমায়েশ খেটে দিবি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত যেমন পেয়ে যাবি, তেমনই মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও হয়ে গেল তোর। কিন্তু হোটেল মালিক কথায় কথায় যেমন ধমক-ধামক আর তার সাথে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিত, তা মোটেও পছন্দ হতো না শ্রাবণীর।
একদিন ভোর হওয়ার আগে হোটেল থেকে পালিয়ে, প্রথম মেদিনীপুর লোকাল ধরে, সোজা খড়গপুর স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়েছিল সে। সেখানে কিছুদিন ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ করে একদিন রেল পুলিশের তাড়া খেয়ে, বছর দুয়েক বাদে আবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে আসে সে। তারপর থেকে রোজ সারাদিন ধরে এ ট্রেন ও ট্রেন ভিক্ষে করে বেড়ানোর শেষে, রাতে ফিরে আসত এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত শ্রাবণী।
আর রোজ সন্ধ্যায় অর্জুনের পাশে বসে, কোলে চেপে, সবচেয়ে ছোটো যে মেয়েটা স্লেট-পেন্সিল নিয়ে, সবে অক্ষরজ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত; তার নাম শান্তা। শান্তার জন্ম এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই। সেও এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে। জন্ম দেওয়ার পরে, ওকে ফেলে রেখে ওর মা-টা যে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কে জানে! মা-কে ছাড়া অতটুকু শিশু এতটুকু টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি কোনওদিন। ছোটো থেকেই সে এতই শান্ত ছিল যে, অর্জুনই ওর নাম দিয়েছিল— শান্তা!
এদের সঙ্গে অর্জুন দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হলেও, এদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা বানাতে সক্ষম হয়েছে সে; তাও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। এদের বেশির ভাগই আগে প্ল্যাটফর্মে বসে, ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে ভিক্ষে করে বেড়াত। সুযোগ পেলে যাত্রীদের মালপত্র থেকে হাতসাফাই করে, দু’-চার টাকা কামিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত ছিল এরা।
অর্জুন বুঝেছিল, এদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পেট চালানোর একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারলে আর নিয়মিত ভাবে পড়াশোনার জগতে ব্যস্ত করে রাখতে পারলে, তবেই এদের এই অসৎ উপার্জনের থেকে বিরত রেখে, একটা সুস্থ জীবনের আলো দেখানো সম্ভব। তাই সকাল হতেই কোনওদিন লুচি-তরকারি, কোনওদিন কেক, কোনওদিন কলা-পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে, সকলকে আজকাল টিকিয়াপাড়ার রেল লাইনের ধারের স্কুলে পাঠিয়ে দেয় অর্জুন। সেখানে প্রাপ্ত মিড-ডে মিলের সুবাদে দুপুরের খাওয়াটাও জুটে যায় রোজ। রাতে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের ধারে বসে ঘন্টা দুয়েকের পড়াশোনার পরে, একুশজনের এই দলটা চলে যায় হাওড়া স্টেশনের বাইরে নদীর ধারের ভাতের হোটেলে নৈশভোজ সারতে। তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে, ওই গোডাউনের পাঁচিলের ধারেই সবাইকে শুইয়ে দেওয়ার পরে, রাতের এই ক’ঘন্টার জন্য অর্জুনের সারাদিনের সব ব্যস্ততার অবসান।
ক্রমশ…