৪ পর্ব
আরও ঘণ্টা-দুয়েক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরে, অর্জুনরা দেখল, মেয়েটা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, খোট্টা ভাষায় অর্জুন মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?” —সাঞ্ঝা, সাঞ্ঝা ওঁরাও!
—ঘর কোথায় তোমার?
—ভুটকি গ্রাম; তহসিল মাণ্ডু; জিলা রামগড়।
—এখানে এসেছ কেন? ট্রেনেই বা চড়েছিলে কেন?
অর্জুনের প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারল না সাঞ্ঝা। আবার চোখ বুজল সে। এস আই জয়ন্ত ঘোষ এবার রোগীর বেডের পাশের বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অর্জুনকে বলল, “এবার আমাকে ফিরতে হবে অর্জুন। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ফিরে রিপোর্ট করতে হবে অফিসে। তবে এ তো মনে হচ্ছে, তোমার ঝাড়খণ্ডেরই লোক। যেসব জায়গার নাম বলছে ও, তার কিছু কি চিনতে পারলে তুমি?”
এস আই সাহেবের প্রশ্নের জবাবে অর্জুন জানাল, ‘হ্যাঁ, ভুটকি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রামগড় জেলার উত্তর প্রান্তের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাঁচি থেকে পঁচাশি কিলোমিটার, আর রামগড় সদর শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ‘ভুটকি’। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হচ্ছে মাণ্ডু। তাও প্রায় বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে নিকটবর্তী বাস রাস্তা হচ্ছে একশো নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অবস্থিত গোধিয়া সতেরো মাইল; ভুটকি থেকে যার দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। ভুটকির উত্তর এবং পশ্চিম দিক হাজারিবাগের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা— সেই প্রত্যন্ত ভুটকি থেকে মেয়েটা রাঁচি এল কী করে! আর সেই সুদূর রাঁচি থেকে এই হাওড়া স্টেশনেই বা ও এল কী উদ্দেশ্যে!
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অর্জুন আবার জানাল, আপনি এখন ফিরে যান ঘোষদা। আমি আরও একটু থেকে দেখি; যদি কিছু জানতে পারি ওর সম্বন্ধে। তবে ফিরে গিয়ে আপনি যদি একটা কাজ করে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। হাওড়া স্টেশনে ফিরে, আপনার কাজকর্ম সেরে, একটু তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমার পোষ্যগুলোকে বলবেন, হ্যাজাকটা জ্বেলে নিয়ে ওরা যেন পড়তে বসে যায়। সামনেই ওদের পরীক্ষা। কাল ঝড়-বৃষ্টির দরুন পড়াশোনাটা হয়নি ঠিকমতো। আজকে যেন ওরা পড়াশোনাটা শুরু করে দেয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে গিয়ে জানতে চাইব—কে কী পড়ল! আর বিল্টুকে একটু আলাদা করে ডেকে বলে দেবেন, কোনও কারণে আমার ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে ও যেন সবাইকে ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়।”
সন্ধ্যার পরে সাঞ্ঝা চোখ মেললে, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অর্জুন আবার জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমাকে এখানে এই হাওড়া স্টেশনে কে নিয়ে এসেছে?”
—কেউ না, আমি একাই এসেছি! কিন্তু আমি এখন কোথায়? অর্জুনের কাছে চোখ বুজেই জানতে চায় সাঞ্ঝা।
—তুমি রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলে। সেখান থেকে তোমাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি ভুটকি থেকে রাঁচিতেই বা এসেছিলে কেন? আবার ট্রেনে করে হাওড়াতেই বা এলে কেন?
অর্জুনের প্রশ্নে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সাঞ্ঝা। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দু’-হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নিজের বুকফাটা যন্ত্রণার কথা সব উজাড় করে দেয় সে। ওর ভুটকি গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, মনের দরজা খুলে, সব বাইরে বের করে আনে সাঞ্ঝা।
সাঞ্ঝার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার তুটকি গ্রামে। তার পুরো নাম সাঞ্ঝা ওঁরাও। ছোটোবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের এগারো ক্লাস পাশ করে এখন সে বারো ক্লাসে পড়ে। ওদের গ্রামের ছাউপদি প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ওর ঘর ছাড়া। এটা শুধু ওর গ্রামের প্রথা নয়; এটা গোটা গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডের দুঃসহ এক প্রথা। এই প্রথার শিকার হয়ে, সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবকালীন পাঁচ-ছয়দিন ওর গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, গ্রামের বাইরে একটা চালা ঘরের মধ্যে গিয়ে থাকতে হয় ওকে। এ যন্ত্রণা শুধু সাঞ্ঝার নয়। ওখানকার আপামর সব মহিলাদের এই প্রথা মেনে চলতে হয়। সেই ঘরের না আছে কোনও দরজা, না আছে কোনও জানলা।
ক্রমশ…