ঠাকুমাকে শ্মশানে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ গুম মেরে বারান্দায় বসে রইল পূজারিনি। মনে হচ্ছিল যেন অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে সে, বেঁচে থেকেও যেন নেই, এই ঘর, এই সংসার কেবল ছায়াময় অবয়ব মাত্র। কয়েকদিন আগেও যে-মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলেছে, আজ সে হয়ে গেছে বিদেহী। কাল যে বর্তমান ছিল, আজ সে অতীত। কাল যার উপস্থিতি ছিল গোটা বাড়িটা জুড়ে, আজ সে কেবলই স্মৃতি।
বাবা আর ভাই পাড়ার লোকেদের সঙ্গে গেছে শেষ যাত্রায়, ঘরে সে আর মা ছাড়া কেউ নেই, নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোটা বাড়িটাকে। আস্তে আস্তে উঠে ঠাকুমার ঘরে গেল পূজারিনি। অপলকে তাকিয়ে রইল টেবিলে রাখা গত বছর তার জন্মদিনে ঠাকুমার সঙ্গে তোলা ফটোটার দিকে। ঠাকুমা তাকে পায়েস খাইয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হল যেন এখুনি ঠাকুমা উঠে এসে নিত্যদিনের মতো তার ‘সতিন’-এর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা শুরু করবে! মনে পড়ে যাচ্ছিল কত কথা৷
একদিন সন্ধ্যাহ্নিক সেরে চা খেয়ে বিছানায় বসে মাতৃশক্তি পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল নির্মলা। খানিক পরে হঠাৎ চমকে উঠল কানের কাছে কারও ডাকে, ‘টুকি!” মুখ ঘুরিয়ে দেখে পূজারিনি, যথারীতি চুপিচুপি এসে পাশে বসেছে।
কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘দুষ্টু মেয়ে, এত বড়ো হলি এখনও তোর সেই ছোটোবেলার স্বভাব গেল না। খালি পিছন থেকে কানের কাছে ডেকে চমকে দেওয়া।”
—এ স্বভাব মরলেও যাবে না বুড়ি, তুই যে আমার সতিন। বলে দু’হাত দিয়ে ঠাকুরমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে মুখ ঘষতে লাগল।
—ছাড় বাবা, উলটে পড়ে হাত-পা ভাঙব যে, বলে নির্মলা তাকে যতই ছাড়াবার চেষ্টা করে ততই নাতনির বাহুপাশ শক্ত হয়৷ অবশেষে পত্রিকাটা রেখে দিয়ে মুখে চুমু খেয়ে একটু আদর করতে তবে মেয়ে ছাড়ে।
—সতিনকে ছেড়ে দু’দিন পরে তো ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি, তখন তো ভুলেও আমার কথা মনে পড়বে না।
—চিন্তা করিস না, যেখানেই যাব সতিনকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। বুঝলি বুড়ি?
—আর বাজে কথা বলিসনি ছুঁড়ি। মনে যখন প্রেমের রং ধরবে তখন আর কারও কথা মনেই থাকবে না।
—ধুস, কী যে বলিস না তুই?’ লজ্জারাঙা পূজারিনি ঠাকুমার কোলে মুখ লুকাল। আর নির্মলা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল তার মাথায়।
এইরকমই ছিল ঠাকুমা-নাতনির নিত্যদিনের রুটিন। ছোটোবেলা থেকে ঠাকুমাই তার সব— তার কাছে খাওয়া, তার কাছে শোওয়া, যত অভাব অভিযোগ সব ঠাকুমার কাছে। স্কুল মাস্টারনি মায়ের বকুনি আর রাগি মেজাজ তাকে আরও বেশি। করে ঠেলে দিয়েছিল ঠাকুমার দিকে। দাদু যখন তাকে ‘নতুন বউ’ বলে ঠাট্টা করত, আর ঠাকুমা তাকে ‘সতিন’ বলে কপট রাগ দেখাত, সেও অর্থ না বুঝে ‘আমি তোমার সতিন, আমি তোমার সতিন’ বলে ঠাকুমাকে রাগাবার চেষ্টা করত। সেই থেকে তার সতিন ডাকটাই রয়ে গিয়েছিল, হাসিঠাট্টার সময় সতিন বলে রাগাত পরস্পরকে। ছোটোবেলা থেকেই সে ঠাকুমাকে তুই বলে ডাকত, যেটা বড়ো হয়েও আর পরিবর্তন হয়নি।
(চলবে)