মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম জ্যাক লেটন ফেরি টার্মিনালে। এখান থেকেই ফেরি করে যেতে হবে টরোন্টো আইল্যান্ডে। টিকিট কেটে ফেরিতে করে টরোন্টো আইল্যান্ডে পৌঁছোতে পনেরো মিনিট মতো লাগল। ফেরি করে যাবার সময় টরোন্টো শহরকে দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। ওন্টারিও হ্রদের বুকে এই আইল্যান্ড অনেকগুলো ছোটো ছোটো আইল্যান্ড নিয়ে তৈরি। ৫ কিলোমিটার লম্বা এই টরোন্টো আইল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব সহজেই হেঁটে যাতায়াত করা যায়। ফেরি থেকে নেমে আইল্যান্ডের দিকে এগোতেই দেখতে পেলাম ভীষণ ভিড়। এত ভিড় নায়াগ্রা ফলসেও চোখে পড়েনি। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম ভিড়ের মধ্যে সবাই প্রায় ইন্ডিয়ান। কাছেই একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমরা আজ একটা বিশেষ দিনের সাক্ষী হতে চলেছি।
টরোন্টোতে প্রতি বছর জুলাই মাসে ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল হয়। অনেক রকম গান-বাজনা, নাটক, ধর্মীয় আলোচনা, খাবার দোকান— সব মিলে একটা ‘লিটল ইন্ডিয়া’র স্বাদ পেলাম বলা যেতে পারে। অনেকের সাথেই পরিচয় হল। জানতে পারলাম আমেরিকা থেকেও কিছু লোক এসেছে এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য। বিদেশের মাটিতে বসে একসাথে এতজন দেশের লোক দেখতে পেয়ে মনটা একটা অন্যরকম অনুভূতিতে ভরে গেল। অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটা খুব সুন্দর দুপুর কাটিয়ে আবার ফেরি করে টরোন্টোতে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোলাম টরোন্টোর বিখ্যাত সিএন টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। রেস্তোরাঁ ৩৬০-তে ডিনারের জন্য বুকিং করা আছে। ১৯৭৬ সালে তৈরি এই টাওয়ার পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ার হিসেবে গণ্য হতো। ২০০৯ সালে দুবাই এর বুর্জ খলিফা ‘সর্বোচ্চের’ খেতাবটি ছিনিয়ে নিলেও সিএন টাওয়ার আজও তার স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। ৫৫৩ মিটার উঁচু এই টাওয়ারে অনেক কিছু করার বা দেখার আছে। টাওয়ারের নীচে কফিশপে কিছুক্ষণ কফি খেয়ে সময় কাটানো যায়। সাথে যদি ছোটো বাচ্চা থাকে তবে তারা ছোটোদের ‘কিড জোন’-এ গিয়ে খেলাধুলো করতে পারে। কিছুটা সময় পাশের গিফট শপে কাটিয়ে কিছু সুভেনিয়র জাতীয় গিফট কিনে নেওয়া যেতে পারে।
এরপর উচ্চ স্পিড এলিভেটর পৌঁছে দেবে গ্লাস ফ্লোরে। অনেকের মতে এটাই টরোন্টোর সব থেকে জনপ্রিয় আকর্ষণ। প্রতি বছর দুই মিলিয়নের উপর টুরিস্ট এই টাওয়ারে ঘুরতে আসে। দর্শনার্থীরা গ্লাস ফ্লোর থেকে বাইরে বেরিয়ে দড়ি বাঁধা পথে হাঁটতে পারে। ৩৪২ মিটার উপর থেকে শূন্যে ঝুলে নীচের রাস্তা আর মানুষ জনের চলাফেরা দেখাটা যে গায়ে শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা, সেটা হয়তো আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একটাই সমস্যা, এটা দুর্বল চিত্তের লোকেদের জন্য নয়। এর পর ৩৪৬ মিটার উপরে মেইন অবজারভেশন লেভেলে কাচের জানালা দিয়ে ‘বার্ডস আই ভিউ’-এ টরোন্টো শহর দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই বলার নয়। আরও উপরে রয়েছে ‘স্কাই পড়’। এখানে উঠলে হাওয়ার সাথে সাথে টাওয়ারের দুলুনি স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
আমাদের যেহেতু রেস্তোরাঁ ৩৬০-তে বুকিং করা ছিল তাই আমাদের টাওয়ারের বিভিন্ন লেভেলে ঘুরে দেখার জন্য আর আলাদা করে টিকিট কাটতে হয়নি। সিএন টাওয়ার শুধুমাত্র স্থাপত্য শিল্পের জন্য বিখ্যাত বললে হয়তো একটু কম বলা হবে, সেটা টের পেলাম ৩৬০ রেস্তোরাঁতে ঢুকে। এই রেস্তোরাঁ যে রন্ধন শিল্পেও বিশ্বের সেরাদের সাথে এক সারিতে দাঁড়াতে পারবে, সে বিষয়ে মতান্তরের অবকাশ খুব কম। রেস্তোরাঁটি অনবরত ৩৬০ ডিগ্রিতে ঘুরে চলেছে বলেই এই নামকরণ। রেস্তোরাঁর যে-কোনও জায়গায় বসলেই ডিনার শেষ হবার আগে বেশ কয়েকবার সম্পূর্ণ টরোন্টো শহর দেখা যাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে কোনও কোনও সময় নায়াগ্রা ফল্সও দেখা যায়।
৩৬০ রেস্তোরাঁতে অনেক রকম খাবারের তালিকা আছে। নিজের ভোজন বিলাসী মনকে পরিতৃপ্ত করার জন্য এখানে কোনওরকম বেগ পেতে হবে না। সাথে পাওয়া যাবে কানাডা-সহ সারা পৃথিবীর বিখ্যাত পানীয়৷ রোজ না হোক, একদিনই না হয় রাজার মতো করে ডিনার করলাম। ডিনার শেষে মেইন অবজারভেশন আর গ্লাস ফ্লোর লেভেল ঘুরে হোটেলে ফিরলাম।
এটাই আমাদের টরোন্টোতে কাটানো শেষ রাত। কাল সকালের প্লেনে ভ্যাঙ্কুভারের পথে পা বাড়াব। এই কয়েক দিনে টরোন্টো শহর আমার মনের মণিকোঠায় অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে। সময় সুযোগ করে হয়তো আবার আসব এই মোহময়ী তিলোত্তমা টরোন্টোকে দেখতে।
(সমাপ্ত)