যে-কোনও শিশু বাবা-মায়ের মাধ্যমেই গোটা পৃথিবীকে দেখে। দৈনন্দিন বিভিন্ন অভ্যাস থেকে শুরু করে নানাবিধ অনুভব, মনোভাব, উপলব্ধি প্রভৃতি সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শেখে।

আজকের পৃথিবীতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন অর্থের। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে কিংবা শখ-আহ্লাদ মেটাতেও প্রয়োজন হয় অর্থের। সেই অর্থের সংকুলান আমাদের মাসিক নির্দিষ্ট আয় থেকে না মেটানো গেলে তখনই পড়তে হয় অসুবিধায়। সেই মুহূর্তে আপনার সঞ্চিত অর্থই আপনাকে সাহায্য করবে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে। তাই সঞ্চয় করা আমাদের প্রতিটি মানুষেরই অবশ্য-কর্তব্য বিষয়।

আপনার নিজস্ব সঞ্চয়ের পরিমাণ যত বেশি থাকবে, আপনি তত সহজেই বিভিন্ন কাজ সুচারু ভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। এই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ছোটো থেকেই। আপনার স্নেহের সন্তানকে যদি ছোটো থেকেই সঞ্চয়ের ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তুলতে পারেন, তাতে ভবিষ্যতে আপনার সন্তানেরই মঙ্গল। কম বয়স থেকেই সন্তানকে সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও মূল্য বোঝাতে হবে। যদিও এটা রাতারাতি হওয়ার বিষয় নয়। ধীরে ধীরে ওদের এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে।

অর্থের মূল্য বোঝান

মুদ্রাস্ফীতির এই কঠিন সময়ে বাচ্চাদেরও অর্থের মূল্য বোঝা প্রয়োজন। ওদের বোঝাতে হবে যে, আপনি অর্থ উপার্জনের জন্য সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেন। এছাড়াও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন যে, তারা যেটা চায়, সেটা কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে আপনি দিনে কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। এটাও বুঝিয়ে দিন যে, তাদের সব অন্যায় বায়না মেটাতে গেলে পরিবারকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যেতে হতে পারে।

প্রতিটি চাহিদা পূরণ করবেন না

আপনি যদি এমন একজন অভিভাবক হন, যিনি সন্তানদের প্রতিটি ছোটো-বড়ো চাহিদাই তৎক্ষণাৎ পূরণ করেন, তাহলে আপনাকে আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। কারণ পরবর্তীকালে আপনার এই মনোভাব আপনার সন্তানদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা জেদি ও একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে উঠতে পারে। এমনকী উশৃঙ্খল হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। সোজা পথে তারা চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম হলে, হয়তো-বা অসদুপায়ও অবলম্বন করতে পারে। মনে রাখবেন, এরফলে ওরা নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের প্রয়োজন ও বিলাসের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখান।

বাচ্চাদের পিগি ব্যাংক দিন

যদি আপনি চান আপনার শিশুরা সঞ্চয় করতে শিখবে, তাহলে শৈশব থেকেই তাদের অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে শেখান। ওদের ছোটো থেকেই শেখাতে থাকুন যে, কিছু অর্থ ব্যয় করো এবং কিছুটা পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করো। এখন প্রশ্ন, এই সঞ্চিত অর্থ ছোটোরা রাখবে কোথায়? এখানেই বাবা-মায়েদের একটু অভিনবত্বের পরিচয় দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের সঞ্চয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে ওদের হাতে তুলে দিন— কার্টুন চরিত্রসহ একটি পিগি ব্যাংক। ওরাও ওদের প্রিয় কার্টুন চরিত্রের পিগি ব্যাংক-এ টাকা জমা করতে পেরে দারুণ আনন্দ পাবে। সেইসঙ্গে ওদের সঞ্চয় করার অভ্যাসও সহজেই গড়ে উঠবে। পিগি ব্যাংক-এর ঝনঝন শব্দ সবসময় ওদের কিছু টাকা রাখতে অনুপ্রাণিত করবে।

ব্যাংক-এ সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট খুলুন

আপনি সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাসের ইতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন। ওদের এটাও বলুন যে, প্রতি মাসে ওদেরই জমানো অর্থ কীভাবে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এজন্য ওদের নিয়ে যান আপনার নিকটবর্তী কোনও ব্যাংক-এর শাখা অফিসে। সেখানে গিয়ে ওদের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলুন। মনে রাখবেন, আজকাল ব্যাংকগুলিতে বাচ্চাদের নামেও অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা রয়েছে। ওদের অ্যাকাউন্টে ওদেরই টাকা জমা করতে শেখান। এতে ওরা আরও উৎসাহিত বোধ করবে। ওদের আজকের জমানো এই ছোটো-ছোটো অর্থরাশি ভবিষ্যতে পরিমাণে আরও বড়ো হয়ে অতি প্রয়োজনীয় কোনও চাহিদা পূরণে হয়তো সক্ষম হবে।

সঞ্চয়কৃত অর্থ থেকে উপহার দিন।

বাচ্চাদের জমানো অর্থ থেকে ওদেরই প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিতে পারেন। এমনও হতে পারে যে, অনেক দিন ধরে আপনার সন্তান একটি টেবিল ল্যাম্প কেনার কথা বলছে, কিংবা পীড়াপীড়ি করছে পড়াশোনার জন্য আলাদা একটি টেবিল বা চেয়ার কেনার। প্রয়োজনীয় এই জিনিসগুলি সন্তানের সঞ্চিত অর্থ থেকেই ওকে কিনে দিতে পারেন। এছাড়া গল্পের বই, ভিডিও গেমস বা খেলার সরঞ্জাম কেনার আবদারও ওরা নিজেদের জমানো টাকা থেকেই মেটাতে পারবে। এতে করে ওদের সঞ্চয়ের উৎসাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। পছন্দের জিনিস কেনার জন্য আরও বেশি করে টাকা জমাতে চাইবে। শুধু তাই নয়, নিজের জমানো অর্থ থেকে কেনা বলে জিনিসগুলি আরও বেশি করে যত্নও করবে।

পকেট মানি রোজগার

আপনার সন্তানদের প্রতি মাসে নিশ্চয়ই কিছু পকেট মানি দেন। এরই পাশাপাশি ওদের নিজেদেরও পকেট মানি উপার্জন করতে উৎসাহিত করুন। এটি নানা উপায়ে করা যেতে পারে। ওদের দিয়ে মাঝেমধ্যে গৃহস্থালীর কিছু কাজ করান এবং সেই বাবদ পুরস্কার হিসেবে কিছু টাকা দিতে পারেন। আবার আপনার সন্তানকে মাঝেমধ্যে ওর নিজের ঘর পরিষ্কার করতে বলুন। এইজন্য আপনি কিছু টাকা ওকে দিতে পারেন। এছাড়া ভাই বা বোনকে হোমওয়ার্ক করালেও কিছু টাকা ওর হাতে তুলে দিন। এতে করে একই সঙ্গে দু’টি কাজ হবে। প্রথমত, আপনার সন্তান গৃহস্থালীর কাজ করার অভ্যাস ছোটো থেকেই রপ্ত করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ও কিছুটা বাড়তি পকেট মানি পেয়ে যাবে, যেটা থেকে কিছুটা আবার সঞ্চয়ও করে ফেলতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, কোনও কাজের জন্য কত টাকা ওদের হাতে তুলে দেবেন, তা ঠিক করবেন কাজটা কতটা কঠিন বা কতটা সময়সাপেক্ষ তার উপর নির্ভর করে। মনে রাখবেন, শিশুরা টাকা পেলে খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং আরও কঠোর পরিশ্রম করতে উৎসাহিত হয়। শুধু তাই নয়, পরিশ্রমের গুরুত্ব বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ওরা পয়সার মূল্যও বুঝতে শেখে।

সঞ্চয়ের জন্য পুরস্কার

আপনার সন্তানকে নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য সঞ্চয়ের একটি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিন। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে ওর হাতে উপহার তুলে দিন। উপহারস্বরূপ নতুন কোনও জামা-প্যান্ট কিনে দিতে পারেন কিংবা ওকে কেক বা আইসক্রিমও খাওয়াতে পারেন। এতে ও সঞ্চয়ের ব্যাপারে আরও আগ্রহী হবে। এছাড়াও আপনার সন্তানের জমানো অর্থের সমপরিমাণ অর্থ আপনি নিজের থেকে দিয়ে ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেন। এতে আপনার সন্তানের উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং আরও বেশি করে সঞ্চয়ের প্রতি মনোনিবেশ করবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...