উদুপি বাজারে এসে স্থানীয় এক রেস্তোরাঁতে বসে উদুপির বিখ্যাত রন্ধনশৈলীর স্বাদ নিয়ে, দক্ষিণ ভারতীয় শাড়ি কিনে চলে এলাম মনিপালে।

পরদিন চললাম টিপু সুলতানের কেল্লা দেখতে। আজ আমরা পরবর্তী কয়েকদিনের টুরের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে নিলাম। সেই গাড়িতেই আমরা চললাম কারওয়ারের দুর্গা মন্দির ও টিপু সুলতানের দুর্গ দেখতে। পথে পড়ল মারাবাস্থে। মারাবাস্থের বিচে লোকজনের ভিড়, কোলাহল কিছুই নেই। কেবল ছোটো ছোটো ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে সাদাবালির বিচের পা ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে গাঢ় নীল সমুদ্রের বুকে। বিচে খানিকক্ষণ থেকে চলে এলাম গাড়িতে। গাড়ি চলল সমুদ্রের উপরের ব্রিজের রাস্তা ধরে।

এই ব্রিজেরই একদিকে আরব সাগর আর একদিকে সুপর্ণিকা নদী। কিন্তু নদী এখানে সাগরে মেশেনি। বরং সাগরের বুক ছুঁয়ে ইউটার্ন নিয়ে চলে গেছে আরও ৬.২ কিলোমিটার। ব্রিজের উপর থেকে সেই অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই গাড়িতে করে আমরা এগিয়ে গেলাম কারওয়ারের দিকে। প্রথমে দুর্গা মন্দির দেখে, তারপর চললাম টিপুসুলতানের দুর্গে। দুর্গের উপর থেকে পাহাড়ঘেরা নীল সাগরের জলে, ঢেউয়ের দাপাদাপি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। তারপর নীচে সমুদ্রের বিচে এসে সাগরের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম। একসময় সূর্য আকাশকে আবিরের রং-এ রাঙিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিল। আমরাও আবার মনিপালে চলে এলাম।

পরের দিন আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় দু’ঘন্টা বাস জার্নির পরে আমরা এসে পৌঁছোলাম কুল্লুরের কোডাচাড্ডি পাহাড়ের পাদদেশে মুকাম্বিকাদেবীর মন্দিরে। কথিত আছে আদি শঙ্করাচার্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে গেলে পুরুষদের খালি গায়ে আর মহিলাদের অঙ্গ ঢাকা পোশাক পরতে হবে। এখানে দেবী জ্যোতির্লিঙ্গ হিসাবে পূজিত হন। যার অর্দ্ধেক শিব ও বাকি অর্দ্ধেক শক্তি বলে মনে করা হয়।

মন্দির দেখে ওখান থেকে জিপে করে চলে গেলাম ৮ কিলোমিটার দূরে, কোডাচাড্ডি পাহাড়ের মাথায় শঙ্করাচার্যের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। প্রথম পাঁচ কিলোমিটার জিপ গেলেও শেষের তিন কিলোমিটার পথ পাহাড়ের চড়াই ভেঙে ট্রেক করেই যেতে হয়। শঙ্করাচার্য মন্দির দেখে আমরা পাহাড় থেকে নীচে নেমে এলাম। তারপর ফিরে গেলাম মনিপালে। এটাই ছিল আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন।

মনিপাল থেকে আমারা আজ গেলাম কালাসা-তে। অপূর্ব সুন্দর পথশোভা দেখতে দেখতে আমরা চললাম পাহাড়ের কোলে এই নির্জন অরণ্যের সাথে একাত্ম হতে। পথে একদিকে পড়ল কফিখেত, অন্যদিকে চা-বাগান। সেখানেই কিছুক্ষণ কফিপানের বিরতি নিয়ে আমরা আবার চললাম। পথে পড়ল অপূর্ব সুন্দর এক মন্দির। সেই মন্দির দেখে তার সংলগ্ন চা বাগনে ঘুরে আবার আমরা এগিয়ে চললাম।

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সবুজে মোড়া অরণ্যের মাঝে কালাসা-র অবস্থান। এখানে এসে আমরা উঠলাম ‘প্রিন্স অফ কালাসা’ নামের অপূর্ব সুন্দর এক হোমস্টেতে। সেখান থেকেই গেলাম ভদ্রা নদীর ধারে। পাহাড়ের উপরে ক্ষীণ অথচ খরস্রোতা এই নদীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। তারপর গেলাম কফিখেত পার হয়ে অরণ্যের গভীরে। সেখানে দেখা হল এক অনিন্দ্য সুন্দর ঝরনার সাথে।

গভীর অরণ্যের মাঝে ভদ্রা নদীর উপরে কাঠের ছোটো ব্রিজ পার হয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে এলাম। সেখানে বসেই সঙ্গে আনা খাবার দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর্ব মেটালাম। সবুজ অরণ্য, পাহাড়, নদী— সব কিছু দেখতে দেখতে কখন যেন প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল। দিনের আলো থাকতে থাকতেই আমরা আবার হোমস্টে-তে ফিরে এলাম। সেখানে এসে পকোড়া সহযোগে কফি পান করেই চলে গেলাম পাহাড়ের মাথায়— দেখলাম সূর্যাস্ত। সেই দিনটা হোমস্টে-তে থেকে পরের দিন চলে এলাম ৬৫ কিলোমিটার দূরের শহর ম্যাঙ্গালোরে। সেখান থেকে বেঙ্গালুরু এসে কলকাতার ফ্লাইট ধরলাম।

প্রয়োজনীয় তথ্য:

১) শালিমার স্টেশন থেকে Vivek Express রাত ১১ টায় ছেড়ে ৪১ ঘন্টা পরে ম্যাঙ্গালোরে পৌঁছায়। এছাড়াও কলকাতা থেকে ম্যাঙ্গালোরের ফ্লাইটও আছে। তবে বেঙ্গালুরু থেকে ট্রেন, বাস বা ফ্লাইটে খুব সহজেই ম্যাঙ্গালোরে যাওয়া যায়। এই পুরো টুরটাই ম্যাঙ্গালোর থেকেও করা যায়। তবে মনিপাল থেকে করলে ওখানকার প্রাকৃতিক  সৌন্দর্য ও মনোরম আবহাওয়া একটা বাড়তি পাওনা। দু-জায়গাতেই বিভিন্ন দামের হোটেল আছে।

২) নিজস্ব গাড়িতে ঘুরলে ইচ্ছেমতন ঘোরা যায়। তবে এখানের সরকারি বাসের পরিষেবাও খুব ভালো।

৩) বর্ষাকাল বাদ দিয়ে অন্য যে-কোনও সময়েই যেতে পারেন।

৪) এখানে চুরি, ডাকাতির কোনও ভয় নেই। তাই নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করুন। স্থানীয় বাসিন্দরা খুবই শান্তিপ্রিয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...