মধ্যবিত্তের কাছে শখের বাগান বলতে ফ্ল্যাটবাড়ির স্বল্প পরিসরে কিছু টব আর অল্প গাছপালা নিয়ে স্বপ্নের সাধপূরণের একান্ত প্রচেষ্টা। প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করা সেইসঙ্গে নিজেকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা। শখের বাগান সকলেই করতে আগ্রহী। বর্ষার সময় সবুজ সতেজ প্রকৃতির রূপ সকলকেই যেমন আকর্ষিত করে, তেমনই মনে আনে গভীর প্রশান্তি। বড়ো বাগান না থাকলেও, সকলেই নিজের নিজের ফ্ল্যাটের জায়গা বুঝে বারান্দার খোলা জায়গায় অথবা বাড়ির অন্দরসজ্জায় টবে রকমারি গাছ লাগিয়ে থাকেন। তবে অনেকেই বর্ষার সময় গাছের ঠিকমতো পরিচর্যা করতে না পারার জন্য সাধের গাছ হামেশাই মরে যায়।
বর্ষাকালে বৃষ্টির জল গাছের জন্য খুবই উপকারী। বৃষ্টির জলে থাকে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফেট, নাইট্রেট ও আয়রন। এছাড়াও বৃষ্টির জলে রয়েছে নাইট্রোজেন যা গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য সুনিশ্চিত করে। এক পশলা বৃষ্টির পর ছাদ বা বারান্দার গাছগুলোকে অন্যরকম লাগে। গাছের সবুজ পাতাগুলো এতটাই সতেজ নির্মল হয়ে ওঠে— যা দৃষ্টি নন্দিত মনে হয়। সাধারণ ট্যাপের জলের থেকে বৃষ্টির জল অনেক বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ, যার জন্যে বর্ষাকালে গাছের পাতাগুলো আরও সজীব আরও সবুজ মনে হয়।
তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি আবার গাছের জন্য অনেক সময় ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির ফলে অনেক গাছ মারাও যেতে পারে। বর্ষাকালে গাছের এই ক্ষতিকর দিকগুলি কী এবং কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে তাই আজকের আলোচনার বিষয়।
উপযুক্ত মাটি তৈরি করুন গাছ লাগাবার আগে
ছোটো কিংবা বড়ো যেমন বাগানই করুন না কেন অথবা টবেই গাছ বসান না কেন— প্রথমেই দরকার মাটি তৈরি করা। তবে বাগানে গাছ লাগানোর জায়গার বেশ কিছুটা অংশের মাটি তৈরি করে নিতে হবে। প্রথমে মাটি খুঁড়ে কিছু কম্পোস্ট জাতীয় সার দিয়ে রাখা ভালো। খুঁড়ে রাখার কিছুদিন পর সেখানে আবার মাটি আলগা করে রাখতে হবে। এরপর গাছের চারা বা বীজ রোপণ করতে হবে। মাটি তৈরির ক্ষেত্রে মাটির সাথে সার মেশানোর সাথে সাথে বালি ও নুড়িপাথর বেশি পরিমাণে মিশিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোকোডাস্ট বা পার্লাইট মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে।
অতিবৃষ্টির সময়ে অবশ্যই এমন ধরনের মাটি নির্বাচন করতে হবে যাতে মাটি খুব দ্রুত জল শোষণ করতে পারে। এর জন্য এঁটেল মাটি ব্যবহার করা উপযোগী। গরমে যেমন টবের মাটি কয়েক ইঞ্চি নীচ পর্যন্ত ভরাট করতে হয়, তেমনই বর্ষাকালে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য টবে মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া উচিত, যাতে জল তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। মাটি তৈরি ছাড়া দায়সারা ভাবে গাছের চারা বা বীজ রোপণ করলে কিছুদিন পরই গাছটি মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যদি গাছটি বেঁচেও যায়, তবুও এটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ফুল বা ফল ভালো হবে না। বরং আপনার সাধের বাগানের শোভা নষ্ট করবে।
গাছকে ছায়ায় রাখুন
বর্ষাকালের অতিবৃষ্টি কিছু কিছু গাছের প্রচুর ক্ষতি করে। ক্যাকটাস বা সাকুলেন্ট সদস্যদের গাছ বেশি জল সহ্য করতে পারে না— তাই এদের খোলা আকাশের নীচে না রাখাই ভালো। এই জাতীয় গাছগুলোকে ছায়ার মধ্যে বা ঘরের মধ্যে রাখা উচিত। বাগানে গাছ লাগানোর সময় বড়ো হলে গাছের আকার কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা রাখা উচিত। কারণ গাছ বড়ো হওয়ার সময় যদি অবাধে ডালপালা বিস্তার করতে না পারে, তবে ফল বা ফুল দেবে না। তাই ছোটো জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। এছাড়া যেসব গাছের সূর্যের আলো সহন করার ক্ষমতা নেই, সেসব গাছ ছায়াযুক্ত স্থানে লাগানো উচিত।
বর্ষায় গাছে বেশি জল দেওয়া চলবে না
অনেকেই এটা নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকেন যে, বর্ষার মরশুমে গাছে জল দেওয়া উচিত হবে কিনা? খোলা আকাশের নীচে যদি টব রাখা থাকে তাহলে জল দেওয়ার দরকার পড়ে না। অতিবৃষ্টির ফলে গাছে জলের ঘাটতি পূরণ হয়। যে-টগুলি শেডে থাকে সেগুলিতে সপ্তাহে দু’বার জল দিলেই যথেষ্ট। মনে রাখবেন গাছের মাটি না শুকানো পর্যন্ত জল দেওয়া উচিত নয়। জলের অভাবে গাছ মরে না কিন্তু জলের পরিমাণ বেশি হলে গাছ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গাছের গোড়ায় মাত্রাতিরিক্ত জল ঢালবেন না। এছাড়া তীব্র রোদের মধ্যে দুপুরে জল দিলেও গাছ মারা যেতে পারে। সাধারণত সন্ধ্যার পর এবং সকালে গাছে জল দেওয়া ভালো।
জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখুন
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গাছে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাড়িতে রাখা যে-কোনও গাছের জন্য এমন টব বা পাত্র বাছাই করা দরকার যেটায় জল নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনমতো ছিদ্র থাকে। যদি বৃষ্টির পরে টবে জল জমে থাকতে দেখা যায় তাহলে টব একদিকে কাত করে জল ফেলে দিতে হবে। আর মাটি না শুকালে একটু খুঁচিয়ে দিতে হবে, যাতে মাটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। যদি গাছের মাটি শুকানোর ব্যবস্থা না থাকে তাহলে ঝড় বৃষ্টির সময় গাছ ঘরে এনে রাখাই শ্রেয়। বর্ষাকালে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয় তার অন্যতম একটি কারণ টবে জল জমে থাকা। তাই নিয়মিত গাছের টবগুলি দেখা দরকার, যেন জল জমে না থাকে।
মাঝে মাঝেই গাছের টব সরিয়ে দিন
বর্ষাকালে অনেক সময় পিঁপড়ে বা অন্যান্য ছোটো ছোটো পোকা টবের নীচে বাসা তৈরি করে। এসব পোকামাকড় গাছের ক্ষতি করে। তাই গাছের টব সরিয়ে নিয়ে পোকামাকড় মারার ব্যবস্থা করতে হবে।
চারা বা বীজ বাছাই করা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের দেশের আবহাওয়া ক্রমে উষ্ণ হয়ে উঠছে। ফলে আপনার বাগানে এবং টবে গাছ রোপণের আগে কী ধরনের বা কোন কোন জাতের গাছ লাগাবেন তা ঠিক করুন। আবহাওয়া ও বাগানের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে এমন জাতের গাছের চারা বা বীজ রোপণ করা উচিত। অন্যথায় শখের বাগান গড়ে তোলার শখ পূরণ হবে না।
কীটনাশক ও সারের ব্যবহার
আবহাওয়া উষ্ণ হলে গাছের পাতায় ও কাণ্ডে নানা ধরনের পোকা বাসা বাঁধে। গাছের পাতা খেয়ে ফেলায় একপর্যায়ে গাছ মারা যায়। সেজন্য কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। শখের বাগানে ক্ষতিকর পোকা দমনে, ব্যবহারবিধি মেনে কীটনাশক দিতে হবে। কীটনাশক কেনার সময় ব্যবহারবিধি অবশ্যই জেনে নিতে ভুল যেন না হয়। তবে প্রচণ্ড বাতাসের দিনে ভুলেও কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে বাকি পাশাপাশি থাকা অন্য গাছের ক্ষতি হতে পারে। সারের মতোই বর্ষাকালে কীটনাশক ব্যবহার না করাই ভালো। তবে পোকামাকড় মারতে জৈব কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত।
৫ মিলি লিটার নিমের তেল, ১০ ফোঁটা সাবান জল ও জল মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করে দিতে হবে। গাছে যদি মুকুল ধরে তখন কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত তাতে অন্যান্য মুকুল বা পাতায় পোকা আক্রমণ করার আশংকা কমে যায়। বর্ষাকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতি ৭ দিন অন্তর অন্তর ফান্সিসাইড স্প্রে করা। কারণ বর্ষায় বৃষ্টির জল জমে ছত্রাক হয়ে থাকে, ফলে গাছের ডালপালা নষ্ট হয়ে যায়। তাই হাতের কাছে যে-কোনও ফান্সিসাইড স্প্রে করে দেওয়া উচিত।
এছাড়া অতিরিক্ত সার ব্যবহারেও গাছ মারা যেতে পারে। বর্ষাকালে সার প্রয়োগ না করাই ভালো। কেন না বৃষ্টির জলে যে পরিমাণে নাইট্রোজেন বা অন্যান্য উপাদান থাকে তা গাছের খাদ্য হিসেবে কাজ করে। তাই সার দেওয়া উচিত নয়। যদি একান্তই সার দেওয়া দরকার মনে হয় তখন জৈব সার দিতে হবে। অন্য কোনও রাসায়নিক সার না দেওয়াই ভালো।
গাছের অবলম্বনের জন্য খুঁটির ব্যবহার
ঝড় বৃষ্টি হলে অনেক সময় গাছ, বিশেষ করে চারাগাছ একদিকে হেলে যায়। তাই গাছের অবস্থান ঠিক রাখার জন্যে গাছের সাথে খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
কেঁচোর উপদ্রব
মাঝে মাঝে দেখা যায় গাছের মাটিতে অনেক কেঁচো হয়েছে। তবে, এতে ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই। কেন না কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙল বা কৃষকবন্ধু বলা হয়। কেঁচো মাটিতে গর্ত করে মাটি আলগা করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে থাকে।
মরা ডাল–পালা কেটে ফেলা উচিত
গাছের মরা ডাল, পচা পাতা বা মরা ফুল-ফল কেটে ফেলা উচিত। শুকনো, অপ্রয়োজনীয় কাণ্ড বা পাতা থাকলে গাছকে যেমন অসুন্দর লাগে, তেমনি গাছে খাদ্য বা জল চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। গাছ বড়ো হলে নিয়মিত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। শুকনো ডাল কেটে ফেলতে হবে। বাগানকে আকর্ষণীয় কারতে ডালপালা ছাঁটাই করা খুবই জরুরি। পাশাপাশি পরিকল্পিত ডালপালা ছাঁটাই, গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে ওঠে।
এছাড়াও বর্ষায় টবের মধ্যে আগাছা, শ্যাওলা জন্মায়। এগুলি মাটির মধ্যে থাকা খাদ্য রস শুষে নেয়, যার ফলে মূল গাছটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা দরকার এবং টবের মাটিতে চারকোলগুঁড়ো দিলে শ্যাওলা জমতে পারবে না।
বর্ষার সময় টগর, জবা, জুই, হাসনুহানা, বেল, নয়নতারা, জিনিয়া, অ্যালামন্ডা, রজনীগন্ধা, ডুয়াজাতীয় টেকোমা গৌরী, গন্ধরাজ প্রভৃতি ফুলের গাছ লাগাতে পারেন বারান্দার টবে। এছাড়াও এই মরশুমে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে রেইন লিলি এবং বিভিন্ন ধরনের অর্কিড। এগুলোতে যেমন কম পরিচর্যা লাগে তেমনি প্রচুর পরিমাণে ফুল ভরে থাকে— যা আপনার ব্যালকনির শোভা কয়েকগুন বাড়িয়ে দেবে। বর্ষার গাঁদাফুল করতে পারেন। এটা শুধু শীতকাল নয়, বর্ষাকালেও হয়।
আজকাল টেবিল কামিনীও পাওয়া যায়। বনসাই টবে এই জাতীয় কামিনী ফুলের গাছ খুবই ভালো হয়। ড্রেসিং রুমের জানলা বা টেবিলে খুব সহজে রাখা যায়। গোটা গাছ সুগন্ধী ফুলে ভরে থাকে, সেইসঙ্গে এর পাতাও খুব আকর্ষর্ণীয়। এই গাছ-সহ গোটা টবটা দেখতে খুবই দৃষ্টিনন্দন। তবে মরশুমি ফুল গাছই সব থেকে ভালো কারণ দীর্ঘজীবী অথবা বৃক্ষ জাতীয় গাছ টবে বাঁচিয়ে রাখা খুব মুশকিল।
বর্ষাকাল হচ্ছে গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। অল্প যত্নেই জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে রোপণ করা গাছ বাঁচানোর সম্ভবনা অনেক বেশি। ফলে যারা বাড়ির বারান্দায় বা ছাদে শখের জন্য ছোট্ট বাগান করতে চান, তাদের এখনই কাজে লেগে পড়া উচিত। বাগান করার আগে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ইচ্ছে থাকলে কাজটা খুব সহজ। তবে সামান্য ভুলে মাঠে মারা যেতে পারে আপনার পরিশ্রম। সেই সঙ্গে বাগান করার শখও মাটি হতে পারে।